নেত্রকোনায় আফালের পেটে বিলীন ২০ গ্রাম
নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরীসহ বিভিন্ন হাওরাঞ্চলে প্রচণ্ড ঢেউয়ের তাণ্ডবে বেশিরভাগ গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার লোকজন পরিবার-পরিজন নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক মধ্যে দিনযাপন করছে।
বর্ষাকালে হাওরে ঝড়ো বাতাসে যে বড় বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় স্থানীয় লোকজন তাকে ‘আফাল’ বলে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ো হওয়া বাড়তে থাকে। বাতাস যত বাড়ে আফালের তাণ্ডবলীলা তত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। তাই বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওরবাসীর মধ্য্যে আফাল আতঙ্ক দেখা দিতে শুরু করে। তিন থেকে চার ফুট উঁচু উঁচু এক একটি ঢেউ আছড়ে পড়ে গ্রামগুলোতে।
হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে প্রতি বছর আফালের তাণ্ডবে প্রায়ই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ভেঙে যায়। বিগত কয়েক দশকের মধ্যে খালিয়াজুরী উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রাম টেউয়ের তাণ্ডবে বিলীন হয়ে গেছে।
বিলীন হয়ে যাওয়া গ্রামগুলো হচ্ছে জগদীশপুর, মাগনপুর, বিক্রমপুর, কানাইনগর, সুলতানপুর, আমীনপুর, খুরশীগঞ্জ, কালিপুর, হ্যামনগর, আছানপুর, নূরপুর, কাছারীবাড়ী, হাবিবপুর, দূর্গাবাড়ী, নগর, শিবপুর, কামারবাড়ী, নরসিংহপুর, নয়ানগর ও সঁওতাল গ্রাম। প্রাচীন মানচিত্রে ও ভূমি রেকর্ডে এ গ্রামগুলো উল্লেখ থাকলেও এগুলো এখন শুধুই হাওর।
হাওরের বুক চিড়ে দিনরাত বড় বড় কার্গো, লঞ্চ ও ট্রলার চলাচল করায় এ থেকে সৃষ্ট ঢেউ ও ধনু নদীর তীব্র স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এ ছাড়া এই ঢেউয়ের থাবা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না হাট-বাজারগুলো।
খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের বেশ কয়েকটি সরকারি ভবন ঢেউয়ের তাণ্ডবে যেকোনো সময় হাওরের পানিতে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
আফাল মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় জগন্নাথপুর, রসুলপুর, লক্ষ্মীপুর, মুজিব নগর, বল্লভপুর ও পাঁচহাট চরপাড়াসহ বিভিন্ন গ্রাম নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা করছে এলাকাবাসী।
বর্তমানে হাওরবাসী আফালের তাণ্ডব থেকে তাদের বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট রক্ষার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার অনুরোধ জানালেও তাদের টনক নড়ছে না। তাই গ্রামবাসী বাধ্য হয়ে বাড়িঘরের চারপাশে খড়, কচুরিপানা, ধারি ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে এক ধরনের প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরি করে বাড়িঘর রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি ভাঙনের মুখে পড়েছে গাজীপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের শতাধিক পরিবার।
গাজীপুর পাঁচহাট গ্রামের আবুল হাসেম বলেন, ‘হাওরে ঢেউ শুরু হলে রাতে সন্তানদের নিয়ে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। আতঙ্কে থাকি কখন কী হয়।’
বল্লভপুর গ্রামের সঞ্জিত তালুকদার বলেন, ‘হাওরাঞ্চলে পানি সহিষ্ণু হিজল, করচ ও চাইল্যা বন আশঙ্কাজনকহারে কমে যাচ্ছে। এ কারণে প্রতি বছরই আফালের তাণ্ডবে বাড়িঘর ভেঙে যাচ্ছে।’
জগন্নাথপুর গ্রামের জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আফালের তাণ্ডবে গ্রামগুলো ভেঙে গেলেও ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা এবং উপজেলা প্রশাসন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’
নেত্রকোনা কৃষক সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আনিছুর রহমান বলেন, ‘হাওরবাসীর দুঃখ কেউ বুঝতে চায় না। নির্বাচন এলে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও এমপি প্রার্থীরা আফালের তাণ্ডব থেকে বাড়িঘর রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা আর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেন না।’
খালিয়াজুরীর রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট মাসুদ রানা চৌধুরী বলেন, ‘হাওরবাসীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে নদী খননসহ গ্রামগুলো রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করতে হবে।’
খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কিবরিয়া জব্বার বলেন, ‘সর্বনাশা আফালের তাণ্ডব থেকে গ্রামগুলো রক্ষার জন্য এর সামনে ব্যাপকহারে হিজল, করচ, ঢোল কলমি ও ধৈঞ্চা জাতীয় পানিসহিষ্ণু ঢেউ প্রতিরোধক গাছ লাগাতে হবে এবং সরকারি উদ্যোগে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম জানান, সরকারি ও বেসরকারিভাবে হাওরাঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় গ্রাম ও হাটবাজারের চারপাশে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ সব গ্রামে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা হবে। সেইসঙ্গে ধনু নদী খননের জন্য প্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।