মানবসেবায় অবদানের জন্য চট্টগ্রামে ডা. রামপ্রসাদকে সংবর্ধনা
বিশ্ব বরেণ্য নিউরো সার্জন অধ্যাপক ডা. রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত রবিনকে সংবর্ধনা দিয়েছে শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রম চট্টগ্রাম কেন্দ্র। শুক্রবার দুপুরে নগরীর উত্তর ফতেয়াবাদে এই সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রম চট্টগ্রাম কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ড. রামপ্রসাদ সেনগুপ্তকে সম্মাননা জানিয়ে ক্রেস্ট ও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আলহাজ আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘বিশ্ব বরেণ্য নিউরো সার্জন অধ্যাপক ডা. রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত রবিন ওবিই মানবসেবার কালজয়ী আলোকবর্তিকার উদ্ভাসিত এক কর্মবীর। প্রবাহমান সমাজের অহংকার। বাংলা ও বাঙালীর গৌরব এবং গর্বের ধন।’
মেয়র আরো বলেন, ‘এ বরেণ্য চিকিৎসকের জীবন পরিক্রমা সবার অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। প্রবল ইচ্ছা শক্তিতে তিনি বিরল গুণের অধিকারী হয়েছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করার প্রত্যয়ে তিনি জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সুউচ্চ শিখরে। তাঁর জীবনের পাতায় একে একে যোগ হয়েছে অবিস্মরণীয় সাফল্যের পালক। ড.রামপ্রসাদ নাড়ির টানে চট্টগ্রামে এসেছেন। তিনি তাঁর জন্মস্থানকে ভুলেননি। ৬৪ বছর দেশ থেকে বিছিন্ন থেকেও তিনি তাঁর জন্মভূমির কথা ভুলে যাননি। তিনি মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বমানের নিউরো সার্জন সেন্টার ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস কলকাতা। ’
তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে চিকিৎসকরা অনুপ্রেরণা পাবে বলে মেয়র প্রত্যাশা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রফেসর ডা. রাম প্রসাদ সেনগুপ্ত অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তি। যে জাতি জ্ঞানীর মূল্যায়ন করে না সে জাতি কখনো উন্নত হতে পারে না। গুণী এ ব্যক্তি শুধু চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের নয়, বরং বিশ্বের গর্ব। তাঁর জীবন ও আদর্শ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাঁর জীবন আদর্শ সম্পর্কে বেশি বেশি জানতে হবে।’
অনুষ্ঠানে ডা. রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত তাঁর বর্ণাঢ্য চিকিৎসা সেবায় পথ পরিক্রমা সম্পর্কে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য দেন। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে স্কুলে যেতে পারতেন না বলে জানান। তিনি বলেন, সহপাঠীদের কাছে গিয়ে তিনি জেনে নিতেন স্কুলে কী পড়ানো হয়েছে। তাদের বই থেকে পাঠ্য বিষয় লিখে নিয়ে পড়াশোনা করতেন। ১২ থেকে ১৩ বছর বয়স থেকে তিনি শুরু করেছিলেন টিউশনি। ১৯৫৩ সালে ফতেয়াবাদ আদর্শ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেয়ে মেট্রিক এবং ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি।
পরে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। পরে ভারতের একটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি গৃহ শিক্ষকতা করে ১৯৬১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস পাস করেন তিনি।
এই প্রসঙ্গে ডা. রামপ্রসাদ বলেন, ‘জীবনটা ছিল হালবিহীন নৌকার মতো। ঘুরে বেড়িয়েছি এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে। তবে কখনো হতাশায় ভেঙে পড়িনি। আমাকে একজন ভালো ডাক্তার হতে হবে। এই ইচ্ছাই ছিল আমার মনের ভিতর।’
১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ও এফআরসিএস করার জন্য লন্ডনে পাড়ি দেন ডা. রামপ্রসাদ। ১৯৬২ সালে তিনি ডাক্তার হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘সফলতা অর্জনের মূল সোপান হচ্ছে দৃঢ় প্রত্যয়, অসামান্য অধ্যাবসায় ও অদম্য ইচ্ছা শক্তি। শিক্ষা মানুষকে মানুষের অন্তর্নিহিত সুপ্ত প্রতিভা মেধা ও বুদ্ধিকে বিকাশ করে। এটি মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে। বিবেচনা শক্তি উদ্ভাবন ক্ষমতা ও সৃজনশীলতাকে উদ্বুদ্ধ করে। শিক্ষাই একজন মানুষকে মনুষ্যত্বের গুণাবলী সমৃদ্ধ করে এবং যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ’
সিটি মেয়র নাছিরকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নিউরো বিভাগকে আরো সমৃদ্ধের জন্য তাঁর পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন ডা. রামপ্রসাদ।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামে নন্দীরহাটে ১৯৩৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ডা. রামপ্রসাদ। তাঁর বাবা ডা. রোহিনী রঞ্জন সেনগুপ্ত ছিলেন হোমিও চিকিৎসক। তাঁর মা মনিকুন্তলা সেনগুপ্তা ছিলেন গৃহিণী, শিক্ষিত ও ধর্মনুরাগী। তিন ভাই দুই বোন নিয়ে তাঁদের পরিবার। বাবার ভালোবাসা ও কঠোর অনুশাসন এবং মায়ের মমতা ও পারিবারিক ধরাবাধা নিয়মের মধ্যে তাঁরা বড় হয়ে উঠেছেন। নন্দীরহাট শৈলবালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়।
ডা. রবিন ১৯৬৭ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এফআরসিএস, ১৯৭৭ সালে নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০১ সালে ডারহ্যাম ইউনিভার্সিটি ও ২০০৯ সালে ভারতের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স থেকে ফেলোশিপ করেন। এর আগে ১৯৭৩ সালে দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি যুক্তরাজ্যের নিউ ক্যাসেল জেনারেল হাসপাতালে ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
২০০২ সালে নিউ ক্যাসল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের অপারেশন থিয়েটারের নাম রাখেন দ্য রবিন সেনগুপ্ত থিয়েটার। ২০১২ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে বিবেকানন্দ সম্মাননা গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে ‘নিউরো সার্জিক্যাল কনট্রিবিউশন অ্যান্ড নিউরো সার্জিক্যাল ডেভেলপমেন্ট’র জন্য ইংল্যান্ডের রানি কর্তৃক প্রিন্স চার্লস থেকে অফিসার অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার (ওবিই) গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে দ্য ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব নিউরো সার্জিক্যাল সোসাইটি থেকে দ্য মেডেল অব অনার দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে কলকাতার মল্লিক বাজারে ১৫০ শয্যার নিউরোলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন ড. রবিন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রম পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মনোজ কান্তি দে। সভায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রফিকুল আলম, কাউন্সিলর তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন পটিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. তিমির বরণ, কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ, নির্বাহী প্রকৌশলী শাহিনুর ইসলাম, বিপ্লব দাশ।