‘ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতের নেকাব সরিয়ে আপত্তিকর প্রশ্ন করেছিলেন’
ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন নুসরাতের মা ও ছোট ভাই। আজ বুধবার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালতে এ সাক্ষ্য গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
সাক্ষ্যে ছোট ভাই রায়হান বলেন, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা করতে গেলে ওসি মোয়াজ্জেমের রুমে আপুকে ডেকে নেওয়া হয়। আমাদের সবাইকে বাইরে থাকতে বলে। ওসির রুম থেকে বের হওয়ার পরে নুসরাত আপু কান্না করতে করতে বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম তাঁর নেকাব সরিয়ে আপত্তিকর প্রশ্ন করেছেন। মামলা দায়ের করার পর থানা ত্যাগ করে আমরা চলে আসি। এরপর গত ১২ এপ্রিল আমরা ফেসবুক ভিডিওতে দেখলাম, আপত্তিকর প্রশ্ন করা হচ্ছে।
এরপর আদালতে ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, নুসরাতের মা সাক্ষ্যে বলেন, গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে নিয়ে আমরা থানায় গিয়েছিলাম। এরপর নুসরাতকে ওসির রুমে ডেকে নিয়ে যায়। ওসির রুমের ভেতরে আমাদের ঢুকতে দেয়নি। এর কিছু সময় পরে নুসরাত বের হয়ে আসে। বের হয়ে সে জানায় তার কথা কেউ একজন ভিডিও রেকর্ড করেছেন। এ ছাড়া গত ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়েছিল। সেই আগুন ধরানোর ভিডিও ৩০ মিনিট পরে ওসি মোয়াজ্জেম মিডিয়াতে ছেড়ে দেন।
এরপর ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ নুসরাতের মা ও ছোট ভাই রায়হানকে জেরা করেন। জেরা শেষে বিচারক আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেন।
গত ১৬ জুন বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর হাইকোর্ট এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগরের শাহবাগ থানা পুলিশ। এরপর ফেনীর সোনাগাজী থানাকে অবহিত করে তারা। এরপর তাকে ১৭ জুন সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারক তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানাতে সোনাগাজী থানায় যায়। থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন সে সময় নুসরাতকে আপত্তিকর প্রশ্ন করে বিব্রত করেন এবং তাঁর ভিডিও ধারণ করেন। ওই মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় ৬ এপ্রিল আরবি পরীক্ষা চলাকালে নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেয় অধ্যক্ষের অনুগত ছাত্রছাত্রীরা। নুসরাতকে সেদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। এরপর নুসরাতের জবানবন্দির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন ওসি। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত।
ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন। আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত শেষে ২৬ মে পিবিআই আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। পরের দিন মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। তারপর থেকেই পলাতক ছিলেন মোয়াজ্জেম।
কী আছে তদন্ত প্রতিবেদনে
গত ২৬ মে পিবিআই সদর দপ্তরের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রিমা সুলতানা ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা আছে, বিবাদী সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর অফিস কক্ষে উপস্থিত ভিকটিমের অপরিচিত কিছু পুরুষের সামনে যৌন নিপীড়নের বক্তব্য শুনেন এবং ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, ওসি ভিকটিমকে বলেন, অধ্যক্ষের কক্ষে তুমি নিজে গিয়েছিলে কি না, তোমাকে কেউ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিব্রতকর প্রশ্ন করেন।
ওসি ভিকটিম নুসরাতের যৌন হয়রানির বর্ণনা শুনার পরও বলেন, এটা কোনো ব্যাপার না। এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে এমন কাঁদতে হবে। ঘটনার একপর্যায়ে ওসি মোয়াজ্জেম ভিকটিমকে জিজ্ঞাসা করেন অধ্যক্ষ তোমার বুকে হাত দিয়েছিল কি না?
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যেহেতু নারী ও শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থানায় আসে, সেহেতু নারী ও শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ সদস্যদের আরো বেশি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। বিবাদী মোয়াজ্জেম হোসেন ওসি হিসেবে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভিকটিম নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও ধারণ এবং প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।