‘ওরা নার্স হলে শত শত রোগী মারা যাবে’
‘ওরা (কারিগরি থেকে পাস করা) যদি নার্স হয়, আমি গ্যারান্টি দিযে বলতে পারি হাসপাতালে প্রত্যেকদিন শত শত রোগী মারা যাবে তাদের ভুল ইনজেকশনের জন্য। কারিগরিরা কখনো হাসপাতালেই বারান্দায়ও যায়নি। তারা কীভাবে আমাদের সমমান দাবি করে? এটা আমার মাথায়ই আসে না।’
অবস্থান কর্মসূচিতে ঠিক এভাবেই এনটিভি অনলাইনকে কথাগুলো বলেন সিলেট নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী রুনা। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর বিজয়নগরে বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের সামনে ‘কারিগরিমুক্ত কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষা চাই’ দাবিতে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।
রুনা আরো বলেন, ‘এমন ইনজেকশনও আছে আমরা যদি আইভির স্থানে যদি আইএম দিয়ে ফেলি তাহলে রোগী সঙ্গে সঙ্গেই মারা যাবে। কারিগরিদের এসব বিষয়ে নলেজ নেই। তাদের দ্বারা অনেক রোগীই মরতে পারে। আমরা চাচ্ছি ডব্লিউএইচও অনুসারে নার্সিংয়ের গুণগত মান ধরে রাখার জন্য ডিপ্লোমা বা বিএসসিদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হোক আর কারিগরিদের অবশ্যই অবশ্যই বয়কট করা হোক।’
রুনা ছাড়াও অনেক শিক্ষার্থী ঢাকা নার্সিং কলেজ থেকে লেখাপড়ার পর ইন্টার্নশিপ করেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তবু চাকরির জন্য লাইসেন্সিং পরীক্ষা দিতে পারছে না তারা। কারণ এক বছর ধরে লাইসেন্সিং পরীক্ষা নিচ্ছে না বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল। ফলে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে যোগ দিতে পারছে না। এতে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছে তারা।
ঢাকা নার্সিং কলেজ থেকে নার্সিংয়ের ওপর বেসিক বিএসসি শেষ করেছেন নাজমুল ইসলাম। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলে তাঁর লাইসেন্সিং পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করে কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেয়, ‘পরীক্ষা আপাতত হচ্ছে না’। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত পরীক্ষা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
নাজমুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নার্সিংয়ের ওপর বেসিক বিএসসি ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ইন্টার্নশিপ শেষ করেছি। এখন কোথাও চাকরি পাচ্ছি না। কারণ আমাদের লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন হয়। পরীক্ষা না হওয়ায় আমরা লাইসেন্স পাচ্ছি না। ফলে আমি এখন বেকার দিন কাটাচ্ছি। আমার সময়ও নষ্ট হচ্ছে। আমরা রাস্তায় না নেমে কোথায় যাব?’
রাজধানীর বিজয়নগরে বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের সামনে আজ মঙ্গলবার সকালে ‘কারিগরিমুক্ত কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষা চাই’ দাবিতে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। ছবি : এনটিভি
রংপুর থেকে আসা ঢাকা নার্সিং কলেজ থেকে নার্সিংয়ের ওপর বেসিক বিএসসি শেষ করা নাহিদ সুলতানা সম্পা এনটিভি অনলাইনকে জানান, এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ এবং নার্সিং কলেজ থেকে ভালো ফলাফল করেও লাইসেন্স পরীক্ষা না হওয়ায় চাকরিতে প্রবেশ করতে পারছি না।
‘স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। সেটা সম্ভব হয়নি বিধায় সেবা পেশা থাকার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নার্সিং কলেজে ভর্তি হলাম। পরিবারের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এত কষ্ট করে পড়াশোনা করার পর পরিবারের আশা ছিল একটি ভালো চাকরি করে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করব। কিন্তু সেটাও লাইসেন্সের অভাবে হচ্ছে না। এখন এসব সার্টিফিকেটের কী মূল্য রইল? পরিবারকে কী বুঝ দেব?’ বলছিলেন নাহিদ সুলতানা সম্পা।
ঢাকা নার্সিং কলেজ থেকে নার্সিংয়ের ওপর বেসিক বিএসসি শেষ করেছেন সুমাইয়া আক্তারও। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘গত আগস্ট মাসে আমার রেজাল্ট দেওয়া হয়েছে। ইন্টার্নশিপ করছি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রায় এক বছর ধরে পরীক্ষা নিচ্ছে না কাউন্সিল। আমি যদি পরীক্ষা না দিতে পারি তাহলে আমার কোথাও চাকরি হবে না। আর কেউ যদি চাকরি দেয়ও তাহলে বেতন দিতে চাইবে না। কারণ আমার তো রেজিস্ট্রেশনই নেই।’
সুমাইয়া আক্তার আরো বলেন, ‘ধরে নেন আমাকে কেউ চাকরি দিল সার্টিফিকেট ছাড়া। তাহলে আমার বেতন খুব বেশি হলে পাঁচ হাজার টাকা। আমি কি পাঁচ হাজার টাকার চাকরি করার জন্য লেখাপড়া করেছি? চাকরি না করলে বেকার থাকতে হবে। আমার পরিবার আছে না? তারা যে তাকিয়ে আছে তাদের কী হবে? সব মিলিয়ে আমি ভয়ে আছি।’
সাজু আহমেদ সিলেট নার্সিং কলেজে ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। তিনিসহ তাঁর ২৫ জন বন্ধু সিলেট থেকে ঢাকায় এসে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আর কত দিন বসে থাকব এভাবে? পরীক্ষা না দিলে তো কোথাও চাকরি করতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে রাস্তায় নেমেছি।’
কিন্তু বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল পরীক্ষা নিচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এই আন্দোলনের একজন সংগঠক মাহমুদা পারভিন বলেন, “আমরা চাই কারিগরিমুক্ত কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষা নেওয়া হোক। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ‘কারিগরি পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্ট’ নামের একটি কোর্স আছে। ওই কোর্সের অধীনে যারা আছেন, তারা বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের অধীনে আসার জন্য আবেদন করেছেন। এই বিষয়ে তারা একটি মামলাও করেছেন কোর্টে। সে জন্য জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ওই মামলার রায় হবে আগামী ২৪ তারিখ। তাদের জন্য আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে না। আমরা চাই, আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হোক এবং তাদের বাদ দেওয়া হোক। কারণ মেডিকেল বা নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন প্রকৌশলী বা স্থপতিদের দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করা যায় না। তেমনি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও চিকিৎসা শিক্ষা বা নার্সিং শিক্ষা পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। সেজন্য তারা এই কাউন্সিলের আওতায় আসার যোগ্যতা রাখে না।’
এই অন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘আজ আমরা স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে দুই দফায় বৈঠক করেছি। কিন্তু ওই বৈঠকে কোনো ফল আসেনি। এখন আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। উনি আমাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে রাজি হয়েছেন। দেখা যাক কোনো সিদ্ধান্ত আসে কি না।’