নুসরাতের ‘খুনিদের’ আমলনামা
আলোচিত ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার বিচারকাজ মাত্র ৬২ দিনের মধ্যে শেষ হয়েছে। ঘটনার পর থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এসব আসামির সবাই কারাগারে আছেন। আসামিদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা কমিটির সভাপতি, প্রভাবশালী কাউন্সিলর, ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের কর্মী থেকে শুরু করে মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীরাও রয়েছেন।
আসামিদের সংক্ষিপ্ত আমলনামা এখানে তুলে ধরা হলো :
প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌল্লা
সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরকৃষ্ণজয় গ্রামের করিম উল্যাহ সওদাগর বাড়ির মৃত কলিম উল্যাহর ছেলে সিরাজ-উদ-দৌলা। বাবা ছিলেন চা দোকানি। দারিদ্র্যতার মধ্যেই সিরাজ-উদ-দৌলা কামিল পাস করেন। এরপর ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের দৌলতপুর সালামতিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন।
ছয় বছর চাকরি করার পর এক ছাত্রকে যৌন হয়রানি ও দুর্নীতির দায়ে সেখান থেকে চাকরিচ্যুত হন। পরে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রঙমালা মাদ্রাসায় চাকরি নেন। সেখানেও আরেক ছাত্রকে যৌন হয়রানি করে চাকরিচ্যুত হন সিরাজ। পরে ২০০০ সালের ১ জুন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায় উপাধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। অভিযোগ রয়েছে, এখানে চাকরিতে যোগদানের সময় সিরাজ অভিজ্ঞতার জাল সনদ দিয়েছিলেন।
সিরাজ-উদ-দৌলা রাজিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে একসময়ে তিনি জামায়াতের রোকন ছিলেন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ২০১৬ সালে জামায়াত থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে মাদ্রাসায় নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো আওয়ামী লীগে যোগদান করেননি।
স্থানীয় ১১০ জন বিত্তশালীকে নিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা উম্মুল ক্বোরা নামের একটি ফাউন্ডেশন করেন। এই ফাউন্ডেশনের নামে জমি কেনাবেচার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। আবদুল কাইয়ুম নিশান নামের একজন শেয়ারহোল্ডার সিরাজের বিরুদ্ধে এক কোটি ৩৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটি এখনো বিচারাধীন। এ ছাড়া সিরাজের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় একটি নাশকতার মামলাসহ তিনটি মামলা রয়েছে।
পারিবারিক জীবনে পাঁচ ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সিরাজ সবার বড়। ফেনী শহরে তাঁর একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে। বাকি ভাইয়েরা সবাই দিনমজুর, দরিদ্র। সিরাজের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলেকে ডাক্তারি পড়াচ্ছেন। নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গত ২৭ মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে নুসরাত হত্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাঁর নির্দেশেই এই হত্যার ঘটনা ঘটে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে পুলিশ।
মো. নূর উদ্দিন
সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের দক্ষিণ সর্দার বাড়ির দিনমজুর আহসান উল্যাহর ছেলে মো. নূর উদ্দিন। তিনি নুসরাত হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি। নূর উদ্দিনের মা ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের কাজ করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে নূর উদ্দিন সবার বড়। নূরসহ বাকি চার ভাইও সোনাগাজী ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। মায়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সবার অর্ধেক বেতনে পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছেন অধ্যক্ষ সিরাজ। অধ্যক্ষের অনুগত হিসেবে পরিচিত নূর। তবে সে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলে জানা যায়।
নূর মাদ্রাসার ফাজিল শাখার এবং ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক ছিলেন। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
শাহাদাত হোসেন শামীম
উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের চরচান্দিয়া গ্রামের নওয়াব আলী টেন্ডল বাড়ির আবদুর রাজ্জাকের ছেলে শাহাদাত হোসেন শামীম। তিনি এই মামলার তিন নম্বর আসামি। তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ছোটবেলা থেকে বেপরোয়া তিনি। শামীম মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও চরচান্দিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। মাদ্রাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র।
অভিযোগ রয়েছে, এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের কারণে প্রায় তিন বছর আগে গণধোলাইয়ের শিকার হন শামীম। জনতা তখন তাঁকে পুলিশে দিয়েছিল কিন্তু টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ছাড়া পান তিনি। পড়ালেখার পাশাপশি স্থানীয় ভূঞার হাটে মোবাইল ফোনের ব্যবসা করতেন। তাঁর বাবা আবুধাবি প্রবাসী হলেও বর্তমানে দেশে আছেন। শামীমের দুই ভাই মালয়েশিয়াপ্রবাসী। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছে।
অধ্যক্ষ সিরাজের অনুগত হিসেবে মাদ্রাসার অভ্যন্তরে একটি কক্ষে ছাত্র সংসদের নামে নিয়মিত অফিস চালাতেন শামীম। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে চাঁদা আদায় করে অধ্যক্ষ এবং সহযোগীরা ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন। হত্যাকাণ্ডের পর ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।
মাকসুদ আলম
মাকসুদ আলম সোনাগাজী বাজারসংলগ্ন পান্ডব বাড়ির মরহুম আহসান উল্যাহর ছেলে। মামলার চার নম্বর আসামি। চার ভাই আর দুই বোনের মধ্যে মাকসুদ সবার বড়। তিনি পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। পেশায় একসময় সবজি বিক্রেতা ছিলেন। সবার কাছে ‘আলু মুকসা’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বাবাও একসময় সোনাগাজী বাজারের সবজি বিক্রেতা ছিলেন।
২০১৭ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন মাকসুদ। কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে প্রভাব খাটিয়ে সোনাগাজী পৌর এলাকায় একের পর এক জায়গা দখল করতে থাকেন। ‘ভূমিখেকো’ হিসেবে পরিচিতি পান।
সোনাগাজী প্রধান সড়কের পশ্চিম পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন একটি জায়গা ইজারা নেন নুরুল করিম শিল্পী নামের এক ব্যক্তি। তিনি ১৫ বছর ধরে সেখানে ‘শিল্পী স্টিল করপোরেশন’ নামে নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা করে আসছেন। সেই জায়গাটির ওপর দৃষ্টি পড়ে কাউন্সিলর মাকসুদের। ২০১৭ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর ‘শিল্পী স্টিল করপোরেশন’-এর জায়গাটি দখল করেন এবং ১৫ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল লুট করে নিয়ে যায় মাকসুদের ক্যাডাররা। এ ঘটনায় জায়গার মালিক নুরুল করিম শিল্পী মামলা দায়ের করেন। এর পর থেকে অব্যাহত হুমকির মুখে সোনাগাজী ছেড়ে অন্যত্র চলে যান শিল্পী।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার পাশে টিটি আবদুর রবের কোটি টাকা মূল্যের চার শতক জায়গা দখল করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কাউন্সিলর মাকসুদের বিরুদ্ধে। চরগণেশ পাণ্ডব বাড়িতে জায়গা দখল করে ঘর নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া সোনাগাজী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন প্রবাসী আবু সুফিয়ানের স্ত্রী শাহানা আক্তারের ছয় শতক জায়গাও দখল করে নেন মাকসুদ। জায়গা দখলের এমন আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।
অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার মুক্তি আন্দোলনে পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পৌরসভার আরেক কাউন্সিলর শেখ মামুনের সঙ্গে হাতাহাতিতে লিপ্ত হন মাকসুদ। তিনি প্রকাশ্যে অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে অবস্থান নেন।
মো. জোবায়ের
সোনাগাজী পৌর এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তুলাতলি গ্রামের মৌলভী খায়েজ আহম্মদের বাড়ির আবুল বশরের ছেলে জোবায়ের। মামলার পাঁচ নম্বর আসামি। আবুল বশরের সোনাগাজী হাসপাতালের সামনের ‘আল হেরা ফার্মেসি’র মালিক। চার ভাইয়ের মধ্যে জোবায়ের সবার বড়। বাবা জামায়াত সমর্থক হলেও জোবায়ের ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্রলীগকর্মী পরিচয়েই এলাকায় দাপট দেখাতেন তিনি।
মাদ্রাসার ফাজিল ও ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জোবায়েরের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগও রয়েছে। তাঁকে উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের নানার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জাবেদ হোসেন
জাবেদ হোসেন উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের রহমত উল্যাহর ছেলে। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। জাবেদ ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। তাঁর বিরুদ্ধে একটি মাদক মামলা আদালতে বিচারাধীন। তিনি মামলার ছয় নম্বর আসামি।
জাবেদের বাবা রহমত উল্যাহ চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি মাদ্রাসা ছাত্রলীগ শাখা কমিটির সদস্য এবং চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি। অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দেলনের সদস্য জাবেদ অধ্যক্ষের অনুগত ছাত্র হিসেবে পরিচিত।
হাফেজ আবদুল কাদের
হাফেজ আবদুল কাদের সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব সফরপুর গ্রামের মনছুর খান পাঠান বাড়ির আবুল কাসেমের ছেলে। তিনি মামলার সাত নম্বর আসামি। তাঁর বাবা সাহেবের হাটের চা দোকানি। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে আবদুল কাদের পঞ্চম। তিনি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার অনুগত হিসেবে মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকতেন আবদুল কাদের। তাঁর বাবা আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। কাদের সরাসরি ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাজধানীর মিরপুরের ৬০ ফিট এলাকাসংলগ্ন ছাপড়া মসজিদের পাশে বড় ভাই আবদুর রহিমের বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রভাষক আফছার উদ্দিন
সোনাগাজী মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক আফছার উদ্দিন। মামলার আট নম্বর আসামি। মাদ্রাসার পাশাপাশি অতিথি শিক্ষক হিসেবে পড়াতেন সোনাগাজী এনায়েত উল্যাহ মহিলা কলেজে। এ ছাড়া রয়েছে নিজের একটি কোচিং সেন্টার। নুসরাতও আফছার উদ্দিনের কাছে প্রাইভেট পড়তেন বলে জানিয়েছেন তাঁর স্ত্রী।
আফছার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের সওদাগর মাঝি বাড়ির আবদুল হকের ছেলে। দুই ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে আফছার সবার ছোট। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকলেও সমর্থক বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসী। ৬ এপ্রিল তাঁকে গ্রেপ্তার করে সোনাগাজী থানার পুলিশ। ৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়।
আবদুর রহিম ওরফে শরীফ
আবদুর রহিম ওরফে শরীফ উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ পূর্ব চরচান্দিয়া গ্রামের আবদুল মালেক চৌকিদার বাড়ির হাজি আবদুর শুক্কুরের ছেলে। নুসরাত হত্যা মামলার নয় নম্বর আসামি। চার ভাই আর দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। পড়ালেখার পাশাপাশি সোনাগাজী বাজারের একটি দোকানে মোবাইল মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর বাবা আবদুর শুক্কুর আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ একজন কর্মী হিসেবে পরিচিত। আবদুর শুক্কুর দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন, এখন বাড়িতেই থাকেন। তাদের পুরো পরিবারই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আবদুর রহিম মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষের পাশাপাশি ফেনী পলিটেকনিক কলেজেরও প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকার ভাগ্নের বাসা থেকে আবদুর রহিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রহিম অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ছিলেন।
মো. শামীম
মো. শামীম সোনাগাজী পৌর এলাকার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম তুলাতলি গ্রামের আলী জমাদারবাড়ির কৃষক শফি উল্যাহর ছেলে। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। নুসরাতের মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি। অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের কমিটির সদস্য। ২৮ ও ৩০ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তি আন্দোলনের মিছিলে নেতৃত্ব দেন তিনি। তাঁকে বাড়ির সামনে তাঁর বোনের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। তাঁর বাবাও আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। মামলার ১০ নম্বর আসামি।
এমরান হোসেন মামুন
এমরান হোসেন মামুন সোনাগাজী পৌর এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চরগণেশ গ্রামের প্রবাসী এনামুল হকের ছেলে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। মামলার ১১ নম্বর আসামি। পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার দিন তিনি মাদ্রাসায় গেট পাহারার দায়িত্বে ছিলেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, চিকিৎসাধীন নুসরাতের জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে রক্তও দেন মামুন। হাফেজ আবদুল কাদের ও শামীমের দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে আসে তাঁর নাম। পরে তাঁকে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামুন অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি পরিষদ আন্দোলন কমিটির সদস্য। ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
ইফতেখার উদ্দিন রানা
ইফতেখার উদ্দিন রানা সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ঈমান আলী হাজি বাড়ির জামাল উদ্দিনের ছেলে। মামলার ১২ নম্বর আসামি। তাঁর বাবা টিঅ্যান্ডটি কার্যালয়ের অফিস সহকারী। জামাল উদ্দিন এখন রাঙামাটিতে কর্মরত। রানা ওই মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে রানা সবার বড়।
রানাকে রাঙামাটির বাবার বাসা থেকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার মুক্তির দাবিতে মিছিলে অগ্রভাগে থাকতেন। তিনি মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী।
মহিউদ্দিন শাকিল
মহিউদ্দিন শাকিল সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের প্রবাসী রুহুল আমিনের ছেলে। তিনি এলাকায় ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে পরিচিত। আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার ১৩ নম্বর আসামি। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
শাকিল অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি আন্দলেনের মিছিলে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁকে ফেনী শহরের পূর্ব উকিলপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। আরেক আসামি শাহাদাত হোসেন শামীমের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে মহিউদ্দিনের নাম। তিনি ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন।
রুহুল আমিন
নুসরাত হত্যা মামলার ১৪ নম্বর আসামি সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন। তাঁর বিরুদ্ধে অধ্যক্ষ সিরাজকে প্রশ্রয় দেওয়া ও এই হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের চরচান্দিয়া গ্রামের কেরানী বাড়ির কোরবান আলীর ছেলে।
তিন ভাইয়ের মধ্যে রুহুল আমিন সবার বড়। তাঁর বাবা-মা, ভাই ও স্ত্রী-সন্তানেরা সবাই আমেরিকাপ্রবাসী। ২০১৮ সালের শুরুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় রুহুল আমিনকে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁকে দলের সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একসময় সোনাগাজী ছাবের পাইলট হাই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন তিনি। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির (সদ্য বাতিলকৃত) সহসভাপতি ছিলেন তিনি। রুহুল আমিনকে তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।
উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পা
উম্মে সুলতানা পপি ছদ্মনাম (শম্পা) অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার শ্যালিকার মেয়ে। তিনি মামলার ১৫ নম্বর আসামি উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের দরিদ্র রিকশাচালক শহীদ উল্যাহর কন্যা। তিনি ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। গত ১০ এপ্রিল রাতে তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
কামরুন নাহার মণি
কামরুন নাহার মণি সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ঈমান আলী হাজি বড়ির বিজিবি সদস্য মরহুম আজিজুল হকের পালিত কন্যা। ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। গত ৯ এপ্রিল তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বিবাহিত। মামলার ১৬ নম্বর আসামি।
নুসরাত হত্যার নেপথ্যে
মামলার বিবরণে জানা যায়, ফেনী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে চলতি বছরের ২৬ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তাঁর অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ মামলায় গত ২৭ মার্চ পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করে।
সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশে মাকসুদ কমিশনার, সাহাদাত হোসেন শামীম তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে সোনাগাজী বাজারে মানববন্ধন করে এবং থানা ঘেরাও করার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলার অনুসারীরা নুসরাতকে মামলাটি উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু নুসরাত মামলা উঠিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পরে গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে ডেকে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পরে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়।
পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে সোনাগাজীতে জানাজা শেষে নুসরাতকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল নুসরাতকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।
নুসরাতের ওপর হামলার ঘটনায় ফেনী, সোনাগাজীসহ সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। মশাল মিছিল, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে।
তবে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী, থানা পুলিশ, কয়েকজন সুবিধাভোগী সাংবাদিক মরিয়া হয়ে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সে সময়ের জেলা পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে সাফাই গেয়ে নুসরাত আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেয়।
এ প্রতিবেদনের কারণে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকের প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে গত ২৭ মে নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিও প্রচারের এ ঘটনায় আইসিটি আইনে মামলায় ওসি মোয়াজ্জেম বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
পরে এ মামলা তদন্ত করার জন্য পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে গত ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দেন নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. শাহ আলম।
এ মামলায় আটক থাকা চার্জশিটের বাইরের পাঁচজনকে বিচারিক আদালত মামলার দায় থেকে অব্যহতি দেন। তাঁরা হলেন কেফায়েত উল্লা, আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, সাইদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন।
অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। এর পর ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী ও নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এর পর মোট ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত।