বর ৮০, কনে ৬৫
চমক আছে, তবে নেই কোনো জাঁকজমক। জীবনের বহু বসন্ত পেরিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধলেন তাঁরা। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে অনেক স্বপ্ন আর সুখের বাসনা নিয়ে পোড় খাওয়া দুজন মানুষ জীবনের নাও ভেড়ালেন এক ঘাটে।
ঘটনাটি সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল বউবাজার এলাকার। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই এলাকার ৮০ বছরের অন্ধ ভিক্ষুক সাবুর আলী গাজী ও জেলার গাবুরা পাতাখালীর বাসিন্দা ৬৫ বছরের রহিমা খাতুন পুরোনো দিনের স্মৃতি হাতড়েও বাঁধলেন নতুন ঘর। শরিয়ত অনুযায়ী তাঁদের বিয়ে পড়ালেন বিয়ের রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলাম বকুল ।
আজ দুপুরে এ ঘটনা সাতক্ষীরা জেলায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জেলার সবার মুখে মুখে আলোচিত ছিল ঘটনাটি।
‘কপালের ফেরে আজ ভিখারি আমি। অথচ একদিন সব ছিল আমার। সহায়-সম্পদ, জমি-জিরাত, মান-সম্মান... সবকিছু। ছিল ভরা যৌবন। সুখের ঘরও বেঁধেছিলাম। কপালের ফেরে স্ত্রী জাহানারা বেগম শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে অচল অবস্থায় বহু বছর ঘরে পড়ে আছে। আর আমি সব হারিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করি। গত কয়েক বছর ধরে চোখেও দেখি না। এই অবস্থায় ভিক্ষা করতে গিয়ে দুই বছর আগে একদিন এই রহিমাকে পাই। রহিমাই এখন আমার হাত ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। এভাবেই দিনে দিনে গড়ে ওঠে মনের বাঁধন। উথলে ওঠে ভালোবাসা।তাই এই নিবেদন আমার।’ – আঞ্চলিক ভাষায় অগোছালোভাবে হলেও, ঠিক এই কথাগুলোই প্রতিবেদককে বললেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ বর সাবুর আলী গাজী।
কনে রহিমা খাতুন সুন্দরবনের ঠিক পাশের আইলা উপদ্রুত গাবুরা পাতাখালী গ্রামের। বয়স ৬৫ পার করেছেন তিনিও। সুন্দরবনের বাঘ মৎস্যজীবী স্বামী আজগার আলীকে মেরে ফেলেছে নব্বয়ের দশকের শুরুতেই। ছিল তিন মেয়ে। বড় দুজনই মারা গেছেন। বেঁচে আছেন কেবল শারীরিক প্রতিবন্ধী ছোট মেয়ে মরিয়ম বেগম। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁকে বিয়ে দিয়েছিলেন এক ভ্যানচালকের সাথে। মেয়ে আর মেয়েজামাইকে বিয়ের সময় থাকার শেষ আশ্রয়স্থল এক ঘরের ঝুপড়িটুকুও ছেড়ে দিয়েছেন।
থাকার জায়গা ছিল না গত কয়েক বছর। পথেই কাটে দিন আর রাত। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে যা পান, তাতেই চলে দিন। সাথে থাকে নাতনি জোনাকি ।
রহিমা জানান, ‘অন্ধ সাবুর আলীকে দেখে মনে বড় কষ্ট হয়। তাই যতটা পারি তাঁকে ভিক্ষার কাজে চলাফেরায় সাহায্য করতাম। হাত ধরে এদিক-ওদিক নিয়ে যেতাম। দিন-রাত বলে কিছুই ছিল না আমাদের মধ্যে। এভাবে চলতে চলতে কখন যে মনের বাঁধনে ধরা পড়ল সাবুর আলী, তা বুঝতে পারিনি।’
রহিমা প্রতিবেদককে আরো জানান, ‘অনেকে অনেক কথা বলাবলি করত। হাসাহাসি করত। সেই থেকে ভালোবাসা। আর সাবুর আলীও ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে এলো । ভাবলাম আমারও একটি আশ্রয় তো চাই। আর সাবুর আলীর চলাচলও নির্বিঘ্ন হতে পারবে।’
‘তাই তো এ ঘর বাঁধিনু, পাতিলাম নতুন সংসার’– বললেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধা রহিমা খাতুন।
বর সাবুর আলী জানালেন, অসুস্থ বড় বউ তাঁকে আরেকটি বিয়ের অনুমতি দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাত-বেরাতে রহিমার কাঁধে হাত রেখে পথ বেয়ে চলতাম। মানুষ নানা কথা ফিস ফিস করে বলত। সেসব কথা জাহানারাকে খুলে বললাম। জাহানারা বলল, ‘আমি তো বহু বছর বিছানায়। তুমি আরেকটা বিয়া করে পারলে সুখী হও। আমার বাধা নাই।’
সাবুর আলী বললেন, ‘এবার দুইজনে ভয় ছাড়া ভিক্ষা করব। সাথে এই ছোট নাতনিটারেও রাখব। দুজনে এক পোয়া চাল পেলে সবাই মিলে ভাগ করে খাব।’
সাবুর আলী আরো বলেন, ‘দুই মেয়ে রেহানা ও ফারিয়ার বিয়ে দিয়েছি। আছে দুটি নাতনিওৱ। একমাত্র ছেলে মনিরুল বিয়ে করে আলাদা জায়গায় থাকে। আমাদের ভাত দেয় না।’
সাবুর আলী বড় বউ জাহানারাকে নিয়ে এখন থাকেন সদর উপজেলার আলীপুর চেকপোস্টের কাছে সরকারি খাসজমিতে। সেই ঘরেই আজ থেকে নতুন আরেক ঘর বাঁধলেন তিনি। সুখের স্বপ্ন নিয়ে পাতলেন নতুন সংসার ।
বিয়ে রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলাম বকুল বলেন, ‘নিয়ম ও বিধি অনুযায়ী দুজনের বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছি। এখন তাঁরা সুখে থাকুক এটাই চাওয়া।’