চিনির দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, কারসাজির অভিযোগ
দেশের বাজারে চিনির দাম ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনির দাম ৩৮-৪০ থেকে বেড়ে ৭২-৭৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দাম বাড়ার কারণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেও সুস্পষ্ট যুক্তি দেখাতে পারছেন না। ব্যবসায়ীদের কেউ বলছেন, সিন্ডিকেটের কারণে দাম বেড়েছে, কেউ উৎপাদনে ঘাটতি কথা বলছেন, আবার কেউ বা আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দর বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করছেন।
তবে ভোক্তাদের অভিযোগ, মুনাফালোভী মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরাই কারসাজি করে চিনির দাম বাড়িয়েছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বছরে দেশে চিনির চাহিদা ১৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদন হয় ১২ লাখ টন। এর পরও গত বছরের জুলাই থেকে চলতি এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে ১২ লাখ ৭৪ টন।
বাজার-সংশ্লিষ্টদের মতে, পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও ঘাটতির অজুহাত বা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে দেশে খুচরা বাজারে চিনির দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পাইকারি বাজারে মান ও কোম্পানিভেদে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চিনি তিন হাজার ২৭০ থেকে তিন হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৬৫ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৬৬ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭২ টাকা করে। খোলা চিনির চেয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত চিনির দাম তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি।
বর্তমানে দেশের বাজারে এস আলম, সিটি, আবদুল মোনেম, দেশবন্ধু, ইগলু, মেঘনা, পারটেক্সসহ বেশ কয়েকটি শিল্প গ্রুপ পরিশোধিত চিনি সরবরাহ করে। এসব কোম্পানি দেশে উৎপাদিত আখ ও বিভিন্ন দেশের অপরিশোধিত চিনি আমদানির মাধ্যমে পরিশোধন করে বাজারজাত করে। তবে কোম্পানিভেদে দাম কিছুটা কমবেশি নির্ধারণ করা হয়েছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি করা চিনি বাজারে আসতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। বর্তমানে যে চিনি বিক্রি হচ্ছে, তার পাইকারি মূল্য ৪৯ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বাড়ায় আগমীতে পণ্যটির দাম আরো বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রীষ্ম মৌসুমে ও রোজার সময় চিনির ব্যবহার বেড়ে যায়। দ্বিগুণ চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় প্রতিবছর এ সময় পণ্যটির দাম নিয়ে কারসাজির সুযোগ খোঁজেন ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক বছর চিনির দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ না বাড়লেও চলতি বছর অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি মিল মালিকরা সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করছেন বলে জানা গেছে।
চিনির দাম নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুন্সি সফিউল হক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় চিনির দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে দাম নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং টিম ও গোয়েন্দা সংস্থা নজর রাখছে। দেশে চিনির ঘাটতি নেই। সরকারের কাছেও পর্যাপ্ত মজুদ আছে। প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকা দরে আউটলেটে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এটা দেখতে লাল হওয়ায় ক্রেতাদের আগ্রহ কম।’
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে গত ১৫ মে থেকে ১১ জুন পর্যন্ত প্রতিটন চিনির দাম ছিল ৩৫৬ ডলার। পরিশোধন, শুল্ককর, ভ্যাট ও পরিবহন খরচসহ প্রতি কেজির দাম পড়ে ৪৯ টাকা। সেই চিনিই এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়। গত ১৭ জুন থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়ে প্রতি টন ৫০০ ডলার হলেও তার আগেই দেশের বাজারে চিনির দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. গোলাম মাওলা বলেন, ‘প্রতিবছর এ মৌসুমে চিনির দাম কিছুটা বাড়ে। কিন্তু আগে এবারের মতো এতটা বাড়েনি। মূলত দুটি কারণে দাম বেড়েছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে এবং দেশের বাজারে সরবরাহ ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আরো বাড়বে। সে কারণে তারা বাজারে জোগান কমিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার আগেই দাম বাড়িয়েছে মিল মালিকরা।’
ইনভেস্টিং ডটকম সূত্রে জানা গেছে, বুধবার লন্ডনের ফিউচার মার্কেটে প্রতি টন চিনি লেনদেন হয়েছে ৫২৮ ডলার ৪০ সেন্ট। এ হিসাবে এক কেজি চিনির দাম পড়ে ৪৬ টাকা।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘সরবরাহ কম, চাহিদা বেশি। এ সুযোগে সবাই দাম বাড়িয়েছে। সরকারি কারখানায় উৎপাদন নেই। বেশির ভাগ চিনি উৎপাদিত হচ্ছে বেসরকারি কারখানায়। তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারি চিনি ভোক্তারা পায় না। কম দামের এসব চিনি চলে যায় বিশেষ শ্রেণির কাছে। তারাই আবার বেশি দামে বিক্রি করে।’
পাইকারি ব্যবসায়ী মো. বাবলু বলেন, ‘রমজানের শুরুতে দাম বাড়া শুরু হয়েছে। সরকার প্রথম দিকে মনিটরিং ও সরবরাহ নিশ্চিত করলে দাম এতটা বাড়ত না। পুরো চিনির বাজার কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যটির দাম বাড়িয়েছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কোনো হাত নেই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোলা চিনির চেয়ে প্যাকেটজাত চিনির চাহিদা বেশি। কিন্তু পণ্যটির দাম বাড়ার কারণে কোনো কোনো বাজারে আগের কম মূল্য মুদ্রিত চিনির প্যাকেট খুলে চিনি খোলা বস্তায় করে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। বেশি দাম মুদ্রিত নতুন প্যাকেট বাজারে এলেও তা গাঁয়ের দামের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি ৭৫ টাকা মুদ্রিত চিনি ৭৭ থেকে ৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ জুন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয় ৬৫-৬৭ টাকায়। আর তা এক মাসের ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে ৭২-৭৬ টাকায়। গত বছরে একই সময়ে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৩৮-৪০ টাকায়।