বুয়েটে র্যাগ, বুধ-বৃহস্পতিবার এলেই আতঙ্ক!
বুয়েটে আবরার ফাহাদের প্রাণ যাওয়ার পর যে শব্দটি আলোচিত হচ্ছে তা হচ্ছে ‘র্যাগিং’। বুয়েটে র্যাগের নামে ‘বড় ভাই’রা করেছে তার বিবরণ শুনলে গা শিউরে উঠবে। জানা যায়, র্যাগিংয়ের জন্য নির্ধারিত ছিল বুধ ও বৃহস্পতিবার।
গত ৬ অক্টোবর শেরেবাংলা হলে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর থেকেই বুয়েট ক্যাম্পাসে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল র্যাগিং সম্পর্কে। একাধিক শিক্ষার্থী এনটিভি অনলাইনকে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানান।
বুধ- বৃহস্পতিবার এলেই আতঙ্ক
বুয়েটের হলগুলোতে বুধ ও বৃহস্পতিবার আসলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত। প্রতি বুধ ও বৃহস্পতিবারে অনেকেই হল ছাড়ত। র্যাগের ভয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকত।
আইটেম গানে নাচানো
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি প্রথম দিকে অনেক হাসিখুশি ছিলাম। হঠাৎ করে যেন আমার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল। দিনটি ছিল বুধবার। রাত বাজে ১২টা। আমাকে হলের ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার সময় দেখি আমার মতো আরো পাঁচ-ছয়জন। ছাদে আমাদের প্রায় দেড় ঘণ্টা ম্যানার, বুয়েট পলিটিক্স কেন সবার থেকে আলাদা সেটা শেখান বড় ভাইয়েরা। আর পুরো সময়টাতে আমাদের এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখে। একপর্যায়ে আমাকে আর আরেক জনকে একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের সামনে ল্যাপটপে পর্ন ছবি দেখানো হয় এবং পরে একটি আইটেম গানের সঙ্গে নাচানো হয়।’
ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি সেদিন বড় ভাইদের মেন্টাল টর্চারগুলো নিতে পারিনি। সেই দিন ভাবছিলাম কোন বুয়েটে ভর্তি হয়েছি! ইচ্ছে হয়েছিল বুয়েট ছেড়ে দেই। সেই রাতে বাথরুমে ডুকে পানি ছেড়ে অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম। হয়তো ভর্তি পরীক্ষায় দুটা অঙ্ক ভুল করলে কোনোদিন জানতাম না বুয়েটের এ র্যাগ ও রাজনীতির অঙ্কের কথা। এটা শুধু আমার সাথে নয় এ রকম অনেক ঘটনা সবার সাথে প্রায় ঘটত। ১৮ ব্যাচের সবার সাথেই এ রকম কম-বেশি হয়েছে।’
মাথায় একটা বস্তা পরিয়ে পেটানো হয়
এবার তিতুমীর হলের এক শিক্ষার্থী বলেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। তিনিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তিনি বলেন, ‘আমাকে তিতুমীর হলের বড় ভাইয়ের একটি রুমে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে এক ভাই প্রচণ্ড এক চড় মারে। আমার মাথা ঘুরে যায়। চড় খেয়ে, ঠোঁট কেটে যায়। এটা ওদের টেকনিক। আচমকা আঘাত করে টর্চারের মুড ক্রিয়েট করে। এরপর আরেক বড় ভাই আমার বুকে প্রচণ্ড এক লাথি মারে। আমি মেঝেতে পড়ে যাই। কেউ এসে তোলে আমাকে। এরপর আমাকে জোর করে স্বীকার করতে বলে যে আমি শিবির করি। স্বীকার না করলে আমার মাথায় একটা বস্তা পরিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে থেমে থেমে প্রায় এক ঘণ্টা বস্তাবন্দি হয়ে মার খেয়েছিলাম। এভাবে আমি যখন জ্ঞান হারানোর কাছাকাছি চলে গেছি তখন শুরু হয় আরেক টেকনিক। এবার মাথা থেকে বস্তা খুলে একজন এসে খুব আদর করে আমাকে রক্ষা করার ভান করে। বলে যে, আমি শিবির করি এটা বললেই ও আমাকে অন্যদের থেকে বাঁচাবে।’ তিনি বলেন, ‘যাওয়ার সময় আমায় বলা হলো, কেউ যদি জানতে চায়, ‘বলবি রাস্তায় এক্সিডেন্ট করছিস। পাঁচবার আমাকে দিয়ে মিথ্যা উত্তর প্র্যাকটিস করিয়ে যখন ছেড়ে দেয় তখন রাত ৩টা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিতুমীর থেকে বের হয়ে পলাশীর কাছে এসে একটা রিকশা ডাকি। তারপর আমার চাচার বাসায় চলে যাই। এরপরের বুয়েটের বাকি সময়টা একটা ট্রমা নিয়ে কাটিয়েছি। কোনো আনন্দ উল্লাস কাজ করেনি, ক্যাম্পাস লাইফ নিয়ে কোনো ভালোবাসা কাজ করেনি। ঘৃণা আসত নির্লিপ্ত স্বার্থপর সব বুয়েটিয়ানের দিকে তাকালে।
বান্ধবী নিয়ে ঘোরার কারণে মাইর
অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার এক বন্ধু ক্যাম্পাসে তার বান্ধবীকে নিয়ে ঘোরার কারণে রাতে তাকে ডেকে নিয়ে মারা হয়। তারপর আরেকজন কেন ভাইয়ের সিলেক্ট করা রুমে ওঠে নাই, সেজন্যও তাকে মারা হয়। তাকে পায়ে ও পাছায় অন্তত ৪০টি আঘাত করা হয়। এই নির্যাতনের পর অনেকেই হাঁটতে পারছিল না।’
খারাপ ছবি দেখতে বাধ্য করা
শেরেবাংলা হলের একজন বলেন, ‘আমাদের হলে শুরু থেকে প্রতিটি বুধবারের রাতই আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ছিল। প্রথমে হাওয়াই চেয়ার, এক পায়ে দাঁড়ানো, কান ধরে উঠবস করানো, বুকডন দেওয়ানো হতো। এগুলো তাও আমরা মেনে নিতাম।
কিন্তু আমাদের পর্ন ছবি দেখানো হতো। এরপর দৃশ্য অনুযায়ী অভিনয় করার নির্দেশ দেয় বড় ভাইরা।’
ভাইদের না বলে মুভি দেখতে যাওয়া
তিতুমীর হলের একজন বলেন, ‘আমাকে মারার ফার্স্ট রিজন হচ্ছে ভাইদের না বলে মুভি দেখতে যাওয়া। আমি হবস অ্যান্ড শ দেখছি শুনে বলে এটা তো ফালতু মুভি, এটার জন্যও আমারে মারে। একবার র্যাগ দেওয়ার সময় ভাইরা আমাদের এক ক্লাসমেটকে মারতে বলে, আমি মারছিলাম। এটার জন্যও আমাকে মারা হয়, সিএসবিতে আমি ভাইদের না বলে কেন পোস্ট দিছি সেজন্যও মারা হয়। আমাকে যেই দিন ভাইরা র্যাগ দিতে নিয়ে গেল বলছে বুকডন দিতে। আমার হাত ভাঙা কিন্তু তবুও দিতে বাধ্য করেছে।’ তিনি বলেন, ‘আসলে আমার কারো ওপরই ক্ষোভ নেই, নইলে নাম উল্লেখ করতাম। আমি পাপীদের না, পাপকে ঘৃণা করি। আমি স্রেফ চাই বুয়েটে শান্তি আসে তাহলেই আমি খুশি।’
সালাম না দেওয়ায় স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয়
কথা হয় ড. এম এ রশীদ হলের একজন ছাত্রের সঙ্গে। তিনিও নাম না বলার শর্তে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রশিদ হলে সবে মাত্র উঠেছি। এর দুদিন পর আমাকে ডাকা হলো। আগেই একজনকে দিয়ে স্টাম্প আনানো হয়েছে আমি পরে জানতে পেরেছি। তারপর একে একে স্টাম্প দিয়ে পেটানো শুরু করল। সালাম না দেওয়াই ছিল অপরাধ।