জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত রহমান এখন ‘গৃহবন্দি’
‘একসময় আমি পাখির মতো উড়ে বেরিয়েছি। কাজের প্রয়োজনে ঘুরে বেড়িয়েছি দেশ-বিদেশ। যেখানে কাজ করেছি, সেটাই ছিল আমার বাড়ি। আজ আমি অন্যের বাসায় গৃহবন্দি। নিজের থাকার মতো জায়গা নেই। চিকিৎসা করানোর মতো টাকা নেই। স্ট্রোক করার পর দুই বছর ধরেই আমি ঘরেই থাকি, বেরোতে পারি না।’
এনটিভি অনলাইনকে কথাগুলো বলছিলেন ‘মনের মানুষ’ ও ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ছবি দুটির জন্য দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত মেকআপম্যান আবদুর রহমান। ২০১৬ সালে তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়, এর পর থেকেই কাজ করার ক্ষমতা হারান তিনি। অসুস্থ আবদুর রহমানের আশ্রয় এখন প্রয়াত পরিচালক তারেক মাসুদের সহকারী আলী আহসানের বাসায়। টাকার অভাবে চিকিৎসাও বন্ধ রয়েছে আবদুর রহমানের।
কাঁপা কাঁপা গলায় আবদুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “‘ভুবন মাঝি’ ছবির কাজ শেষ করেছি ২০১৬ সালের শুরুতেই। তার কিছুদিন পরই আমি স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে কিছুদিন থাকার পর আমাকে তারেক মাসুদের সহকারী আলী আহসান ভাই তাঁর বাসায় নিয়ে আসেন। তার পর থেকে এখানেই আছি। আমার কোনো বাড়ি নাই, আত্মীয় নাই, টাকা নাই, কাজ করার ক্ষমতাও নাই। এখন কীভাবে বাকি জীবন পার করব, জানি না।”
শারীরিক সমস্যা নিয়ে আবদুর রহমান বলেন, ‘আমি এখন চোখে কম দেখি। শরীর কাঁপে, বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। এমনকি বিছানা থেকে বাথরুমে যেতেও অনেক কষ্ট হয়। কানে শুনতে পাই না। কিছু মনে রাখতে পারি না। এ অবস্থায় সব সময় ভয়ে থাকি, কখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে যাই। তখন আমাকে কে দেখবেন?’
পরিবারে আর কে আছেন—জানতে চাইলে আবদুর রহমান বলেন, ‘আমার কোনো পরিবার নেই। কাজই আমার পরিবার ছিল। আমি বিয়ে করিনি। আমার বাড়ি বিক্রমপুর। বাবা-মা মারা গেছেন অনেক আগেই। বাড়িতে যাই না বিশ বছর। সেখানে আমার কিছু নেই। সারা জীবন কাজ করে গেছি, টাকা সঞ্চয় করার চিন্তা করিনি। সব সময় মনে হতো একা মানুষ, কাজ করে জীবনটা পার করে দেবো। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা আমাকে অসহায় করে দিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করে অসহায় শিল্পী বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক দয়ালু, তিনি তো সব সময় শিল্পীদের পাশে সব সময় দাঁড়ান। আমি উনার কাছে সাহায্য চাই। আমার চিকিৎসা ও থাকা-খাওয়ার একটা ব্যবস্থা যদি তিনি করেন, তা হলে বাকি জীবনটা আমার চলে যায়।’
আবদুর রহমান এখন যাঁর আশ্রয়ে রয়েছেন, সেই আলী আহসান জানান, তিনি প্রতিদিন যখন নিজের কাজে বেরিয়ে যান বা নিজের গ্রামের বাড়ি যান, তখন আবদুর রহমানকে ঘরের ভেতরেই বন্দি হয়ে থাকতে হয়। তিনি খাবার দিয়ে যান বটে, কিন্তু সারাক্ষণ দুশ্চিন্তাও কাজ করে, কখন কী ঘটে যায়।
আলী আহসান বলেন, ‘আমি দুই বছর ধরেই রহমান ভাইকে সঙ্গে রেখেছি। কিন্তু উনার চিকিৎসা করাতে পারছি না। কারণ, চিকিৎসা করাতে অনেক টাকার প্রয়োজন। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি, এখন তো তাও একটু নড়াচড়া করতে পারেন, কিন্তু একবার বিছানায় পড়ে গেলে কে দেখবে তাঁকে? আমি সারা দিন কাজে বাইরে থাকি। তিনি একা একা বাসায় থাকেন। আমরা একসঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছি। সেই হিসেবে আমরা বন্ধুস্থানীয় মানুষ। ভালোবাসা থেকে আমি উনাকে বাসায় নিয়ে এসেছি। আমার সঙ্গে রেখেছি। কিন্তু আমি যখন কুমিল্লা গ্রামের বাড়ি যাই কয়েক দিনের জন্য, আমার স্ত্রী ও পরিবারের কাছে, তখন খুব চিন্তা হয়। সরকার উনার পাশে দাঁড়ালে বাকি জীবনটা উনি একটু নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারতেন।’
আবদুর রহমান প্রথম চলচ্চিত্রে কাজ করেন ১৯৬৫ সালে। ২০১০ সালে ‘মনের মানুষ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ মেকআপম্যান হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৪ সালে মাসুদ পথিক পরিচালিত সরকারি অনুদানের ছবি ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’-এর জন্য দ্বিতীয়বারের মতো শ্রেষ্ঠ মেকআপম্যান হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। সর্বশেষ ‘ভুবন মাঝি’ ছবিতে মেকআপম্যানের কাজ করেছেন আবদুর রহমান।