পর্দার পেছনে
সিনেমার রক্তের ‘রেসিপি’ কী জানেন?
চলচ্চিত্রের খলনায়ককে যেমন মার খেতে হয় নায়কের হাতে, তেমনি নায়কও মাঝেমধ্যে হন রক্তাক্ত। ছবির অন্য চরিত্রদের মুখ ও শরীর দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ার দৃশ্যও বিরল নয় বড় পর্দায়। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, এসব জখমের রক্ত কি আসল, না নকল? ঢাকাই ছবিতে রক্ত হিসেবে যে তরল ব্যবহার করা হয় সেটি আসলে আদৌ সত্যিকারের রক্ত নয়। কয়েকটি জিনিসের মিশ্রণে এই কৃত্রিম রক্ত তৈরি করা হয়। আর কী সেই উপাদান? চলুন জানা যাক চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষের মুখ থেকেই।
চলচ্চিত্র পরিচালক বদিউল আলম খোকন বলেন, ‘রক্ত আমাদের সব ছবিতেই কমবেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশেষ করে মূলধারার চলচ্চিত্রে রক্তের ব্যবহার হয় বেশি। অভিনয়শিল্পীদের কথা ভেবে আমরা সবসময় স্বাস্থ্যসম্মত জিনিস দিয়ে রক্ত তৈরি করি, যেন শিল্পীর কোনও সমস্যা না হয়।’
রক্ত তৈরির স্বাস্থ্যসম্মত উপাদান কী? একটু পরই সেটা জানা যাবে, এর আগে জানা যাক ঢাকাই ছবির অন্যতম খল অভিনেতা মিশা সওদাগর কী বলেন এই রক্ত নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা মারামারির সময় রক্ত ব্যবহার করি। রক্ত মুখে গেলে যেন সমস্যা না হয়, সেটা মাথায় রেখেই সিনেমার রক্ত বানানো হয়। কারণ অনেক সময় দেখা যায় মুখ দিয়ে তরল রক্ত বের হচ্ছে। তখন অবশ্যই কিছু না কিছু রক্ত মুখের ভেতরে যায়। আমার এমন অনেকবার হয়েছে, রক্ত মুখের ভেতর চলে গেছে। আর কাজ করার সময় মুখে গেল কি না, সেটা খেয়াল রাখা যায় না। তাই আমরা যে রক্তটা ব্যবহার করি— সেটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর কিছু নয়।’
রংবাজ’ ছবির দৃশ্যে শাকিব খান ও শিবা শানু। ছবি : সংগৃহীত
ছবিতে সাধারণত দুই ধরনের রক্ত ব্যবহার হয় বলে জানান মিশা সওদাগর। বলেন, ‘আমরা দুই ধরনের রক্ত ব্যবহার করি। তরল রক্ত আর শুকনো রক্ত। কারণ গল্পে এমনও দেখা যায় যে, শিল্পী সকালে মারামারি করেছে রাত পর্যন্ত তিনি মাটিতে পড়ে আছেন। সকালে যদি কারো রক্ত বের হয় তাহলে বিকেলে তা শুকিয়ে যাবে। যে কারণে আমাদের দুই ধরনের রক্ত ব্যবহার করতে হয়।’
রক্ত তাজা হোক অথবা শুকনো, সেটি পেটে গেলে যে কোনো সমস্যাই হবে না, সে কথা বলার পাশাপাশি এর কারণটাও জানালেন চলচ্চিত্রের মেকআপম্যান হক মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা যে রক্ত শুটিংয়ে ব্যবহার করি, তা শতভাগ খাওয়ার উপযোগী। কারণ এই কৃত্রিম রক্তের কাঁচামাল হিসেবে আমরা ব্যবহার করে থাকি শরবত রুহ আফজা, খাওয়ার রং আর ময়দা।’
তরল রক্ত নিয়ে হক বলেন, ‘ধরুন কাউকে ঘুসি দেওয়া হলো, রক্ত ছিটকে পড়ছে অথবা কাউকে বুকে গুলি করা হলো, সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। কারো হাত-পা কেটে গেল, এমন সময়গুলোতে আমাদের তরল রক্ত ব্যবহার করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমরা রুহ আফজা ও রং ব্যবহার করি। রুহ আফজা একটু বেশি তরল থাকে, সেটা দেখতে শতভাগ রক্তের মতো নয়, যে কারণে রং ব্যবহার করে সেটাকে ঘন করতে হয়। যেহেতু রক্ত হতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত, তাই মিষ্টিতে যে রংটা ব্যবহার করা হয় বা কেকে যে খাবারের রংটা ব্যাবহার করা হয়, সেই রংটা ব্যবহার করি।’
শুকনো রক্ত বানানো প্রসঙ্গে হক বলেন, ‘শুকনো রক্ত তৈরি করার জন্য আমরা রুহ আফজা ও রঙের পাশাপাশি ময়দা ব্যবহার করে থাকি। তবে কতটুকু ময়দা ব্যবহার করা হবে তা নির্ভর করে রক্ত কতটা শুকনো হবে সেটার ওপর।’
‘জান্নাত’ ছবির দৃশ্যে সাইমন সাদিক। ছবি : সংগৃহীত
রক্ত তৈরির জন্য কী রকম খরচ হয় জানতে চাইলে হক মিয়া জানান, একেক ছবির জন্য খরচ একেক রকম হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটা ছবিতে রক্তের জন্য পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। সেটা দিয়েই কাঁচামাল কিনি। এই টাকার মধ্যেই সব হয়ে যায়। তবে গুলির দৃশ্যে কারো কারো রক্ত বেশি দরকার হয়। সেরকম দৃশ্যে খরচ একটু বেশিই হয়, কারণ সেক্ষেত্রে রক্ত ছাড়াও প্রয়োজন হয় বেলুন ও বারুদের। দেখা যায়, বেলুনের মধ্যে আমরা রক্ত ভরে, তার সাথে বারুদ যুক্ত করে দেই। বারুদটির সাথে বিদ্যুতের তার লাগানো থাকে। যখন গুলি করা হয়, সেই সময় বিদ্যুতের তার প্লাস মাইনাস এক করে দেওয়া হলেই বারুদ ফেটে যায়। সাথে সাথে তখন রক্ত বের হয়।’
গুলি হওয়ার পর দেহ থেকে রক্ত বেরুবার যে প্রযুক্তি, সেটির প্রত্যেকটির জন্য খরচ পড়ে ১০ টাকা। এমনটাই জানালেন অ্যাকশন ডিরেক্টর চায়নিজ। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এসব দৃশ্যে রক্ত বের করার জন্য আমরা প্রতিটির জন্য নিয়ে থাকি ১০ টাকা। আগে দুই টাকা নেওয়া হতো, তারপর ৫টাকা। এখন সব কিছুর দাম বেড়েছে তাই ১০ টাকা নিয়ে থাকি। এই কাজটি করার জন্য আমাদের দুজন লোক প্রয়োজন হয়। একজন বিদ্যুতের বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে। আরেকজন বারুদ শরীরে সেট করে। এই অ্যারেঞ্জমেন্টের জন্য আলাদা দিতে হয় দুই হাজার টাকা, আর প্রতি বারুদ ১০ টাকা।’
ইদানীং বাণিজ্যিক ছবির সংখ্যা কমে গেছে। সেই সঙ্গে কমে গেছে মারামারির দৃশ্যও। তা ছাড়া গোলাবারুদ দিয়ে অনেকেই আর ছবির খরচ বাড়াতে চান না। তাই রক্তের ব্যবহারও অনেক কমে গেছে আগের চেয়ে। রক্ত যারা তৈরি করে, তাদের ব্যস্ততাও সেজন্য আগের তুলনায় এখন অনেকটাই কম।