ছানির অস্ত্রোপচারের পর লেন্স কেমন হওয়া দরকার?
ছানি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। এখন আধুনিক অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি হলো ফ্যাকোসার্জারি। এই সার্জারির পর চোখে কৃত্রিম লেন্স বসানোর প্রয়োজন পড়ে।
এই ধরনের লেন্স কেমন হওয়া উচিত, এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩০৫২তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. এম নজরুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আই হসপিটালের গ্লুকোমা বিভাগে চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : চোখের ছানি খুব প্রচলিত রোগ। বয়স্কদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হন। তবে আশার কথা হলো অস্ত্রোপচার করে আবার ভালো করা যাচ্ছে। অস্ত্রোপচারের সময় যে লেন্স ব্যবহার করা হয়, এটি নিয়ে নানা জনের মধ্যে নানা প্রশ্ন রয়েছে। খুব কম দামেও পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেক দাম। তবে তার আগে জানতে চাইব, ছানি কী- এই বিষয়ে?
উত্তর : অনেক ধন্যবাদ। আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। আপনারা সবাই জানেন আজকাল ফ্যাকোসার্জারি হচ্ছে। তবে সমস্যা হলো কোন লেন্সটি একজন রোগী নেবে, এটি নিয়ে তারা একটি বিভ্রান্তিতে ভোগে।
তার আগে ছানি নিয়ে বলতে চাই। চোখ তো আসলে ক্যামেরা। ক্যামেরার মধ্যে যখন আলো এসে পড়ে, লেন্সের সাহায্যে ফোকাস হয়ে রেটিনাতে যায়, অপটিক নার্ভের সাহায্যে মস্তিষ্ক সেটি দেখতে পায়। অর্থাৎ মস্তিষ্ক দেখে, চোখটা ক্যামেরার মতো কাজ করে। ক্যামেরার ভেতর যে লেন্সটি থাকে, যে লেন্সের মাধ্যমে ফোকাস হয়ে রেটিনাতে পড়ছে, সাধারণত মানুষের বয়স ষাঠ বছরের বেশি হয়ে গেলে ঘোলা হতে শুরু করে। এই যে লেন্সটা ঘোলা হয়ে অকেজো হয়ে গেল, অকার্যকর হয়ে গেল, এটা হলো চোখের ছানি। অনেকে বলে পর্দা। ছানিটা ঘোলা হয়ে হয় পর্দাটা।
এই ছানি বা লেন্সটা যখন আমরা অস্ত্রোপচার করি, লেন্স তখন ফেলে দেই বা ওয়াশ করে গলিয়ে ফেলে দেই। তাহলে সেখানে তো একটি লেন্স লাগাতে হবে। এই লেন্স যখন লাগাব তখন লেন্সের গুণের ওপর কিন্তু তার দেখা নির্ভর করবে।
এর আগে একটু বলা ভালো অস্ত্রোপচার তো অনেকভাবে করা যায়। একটি অস্ত্রোপচার ছিল আইসিসি। এখন সেটি নেই। কিন্তু এখন করা হয় এক্সট্রা ক্যাপসুল কেটারেক্ট সার্জারি। এসাইসিএস, ফ্যাকোইমালসিফিকেশন ও লেজার ক্যাটারেক্ট সার্জারি। যারা ইসিসি ও এসআইসিএস করেন, তারা কেটে করছেন, ম্যানুয়ালি করছেন। তারা যে লেন্সটা দিচ্ছেন, এটি ভাঁজ করা যায় না, নরম নয়, শক্ত লেন্স। একটু বড় করে কাটা হয়, লেন্সটা জায়গামতো রেখে দিয়ে আমরা হয়তো সেলাই দিই, পানি দিয়ে একে বন্ধ করে দিই। এটি একটি অস্ত্রোপচার। আরেকটি হলো ফ্যাকোসার্জারি। আমরা প্রথমে শুরু করেছিলাম, তিন মিলিমিটার ফ্যাকো। এখন আমরা করি দুই মিলিমিটার ফ্যাকো। অত্যন্ত ছোট একটি ইনসিশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ লেন্সকে দুই ভাগ করি, চার ভাগ করি, আট ভাগ করি।
এই দুই মিলিমিটারের মধ্য দিয়ে ছয় মিলিমিটারের একটি বড় লেন্স কীভাবে ঢুকবে? এই ভাজ করে যখন ঢুকানো হয় সহজে জায়গামতো বসে যায়। একে বলা হয় ভাঁজ করা লেন্স বা নরম লেন্স। আমরা প্র্যাকটিসে ১০০ ভাগ ক্যাটারেক্ট সার্জারি আমি ভাঁজ করা যায় এমন লেন্স দিয়ে করি।
প্রশ্ন : এর সুবিধা কী?
উত্তর : ছোট ইনসিশন দিয়ে হয়, এই সুবিধা। সুবিধা অনেক বেশি। সংক্রমণ কম হয়, ছোট জায়গা হয়। চোখের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করার ১০ মিনিট পর রোগী বাড়ি চলে যাচ্ছেন। পরের দিন সব কাজ করতে পারছেন। ছোট ইনসিশনে অস্ত্রোপচার করা হলে অনেক সুবিধা। দ্বিতীয় হলো ম্যাটেরিয়াল। যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়, এগুলো চোখের জন্য জটিলতা কম করে। এটা সাধারণ লেন্সে বেশি হতে পারে। অনেক বড় লেন্স, অনেক বড় করে কাটতে হয়। চোখের এঙ্গেল পাওয়ার বেশি হয়ে যায়, এখানে অ্যাঙ্গেল পাওয়ার অনেক কম হয়। রিহেবিলেশন অনেক তাড়াতাড়ি হয়। ছোট ইনশিসনের কারণে অনেক সুবিধা হয়।
নরম লেন্সের কথায় আসি। কারণ, শক্ত লেন্সের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। আমাদের দেশে সাধারণত জেলা লেভেলে এসআইসিএসের মাধ্যমে শক্ত লেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু যারা ফ্যাকো সার্জারি করে, তারা কিন্তু নরম লেন্স দিয়েই লেন্স পুনস্থাপন করে। এই যে নরম লেন্স, এটি নানা রকম উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। যেমন হাইড্রোফোবিক লেন্স, হাইড্রোফিলিক লেন্স। পানিতে সমস্যা হয় কিছু লেন্স আবার পানিতে কোনো সমস্যা নেই। এই দুই লেন্সের মধ্যে হাইড্রোফ্লোবিক লেন্সের গুণগত লেন্স ভালো। তাহলে আমাকে বুঝতে হবে কোনটা ভালো গুণগত মানের। দুই নম্বর, এর মধ্যে কিছু রয়েছে আল্ট্রা ভায়োলেট রে ব্লকার। কিছু আবার ব্লক করে না। যে ব্লক করে তার দাম বেশি, ভালো। গুণগত মান ভালো। আবার কিছু রয়েছে এসফেরিক, এসপেরিক। আমরা যে রাতে ভালো দেখি, একে বলা হয় এসফেরিক লেন্স। এর দাম বেশি, গুণগত মান ভালো। যত বেশি ভালো গুণগত মানের দিকে যাবেন দামের তারতম্য হচ্ছে।
আরেকটি লেন্স রয়েছে, টরিক লেন্স। এটা আমরা এখন খুব ব্যবহার করছি। সেটা হলো একটি রোগীকে আমি অস্ত্রোপচার করলাম, তার ভিশন ৬/৬ হওয়ার কথা। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর এটি হচ্ছে না। কেন? কারণ, দেখা যাচ্ছে তার একটা পাওয়ার ছিল প্লাস টুয়েন্টি। এরপর প্লাস ওয়ান রয়ে গেছে ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে। এটাতো আমি ঠিক করতে পারছি না। এখন লেন্স পাওয়া যায় টরিক লেন্স। সেই লেন্সের মধ্যে এক, ৯০ ডিগ্রি দেওয়া রয়েছে। আমি যদি এই লেন্সটা আমার রোগীকে দিতে পারি, তাহলে অস্ত্রোপচারের পর তিনি ৬/৬ কারেকশন দেখবে। এই লেন্সটা হলো টরিক লেন্স। আবার কিছু লেন্স রয়েছে মাল্টিফোকাল লেন্স। অর্থাৎ যে লেন্স দিলে রোগী দূরে দেখবে, কাছে দেখবে। এটিও আমরা এখন অনেক রোগীকে দিতে পারছি। তাহলে দেখুন একটি লেন্সের কিন্তু অনেক রকম ধরন রয়েছে। কোন লেন্সটি ভালো হবে সেটি আসলে চোখের চিকিৎসকই বিবেচনা করবে।
প্রশ্ন : রোগীদের ভেতরে একটি দ্বন্দ্ব থাকে, এই সেন্টারে তো লেন্সের দাম বেশি বলছে, তবে আমার একজন আত্মীয় আরেকটি জায়গায় করিয়েছে সেখানে লেন্সের দাম কম। এই যে বোঝার একটি পার্থক্য, এই বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : খুবই ভালো একটি প্রশ্ন। এটি মানুষের মধ্যে প্রায়ই থাকে। কেউ যখন অস্ত্রোপচার করাচ্ছে, সেই ক্লিনিকের বা হাসপাতালের অবস্থাটা কেমন। কত ভালো মাইক্রোস্কোপে সে অস্ত্রোপচার করছে, কত দামি ফেকো মেশিন দিয়ে অস্ত্রোপচার করছে, ওই সার্জনের অভিজ্ঞতা কত বছরের, সেটি দেখতে হবে।
হয়তো আমি বাংলাদেশে একটি অস্ত্রোপচার করলাম, এর বিশ্বমানের সুবিধা রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে দামি মেশিন দিয়ে আমি অস্ত্রোপচার করি, বিশ্বের সবচেয়ে দামি মেশিন দিয়ে আমি মাইক্রোস্কোপে অস্ত্রোপচার করি। আমার অভিজ্ঞতা ২৫ বছর। কিন্তু আমারই একজন ছাত্র যদি একটি জায়গায় অস্ত্রোপচার করে, যেখানে এত দামি যন্ত্র নেই, তার অভিজ্ঞতা পাঁচ বছর, নিশ্চয়ই সে অনেক কম খরচে অস্ত্রোপচার করতে পারবে।
একই লেন্স দিয়ে একটি জায়গায় হয়তো ২০ হাজার টাকা দিয়ে অস্ত্রোপচার হচ্ছে। আরেক জায়গায় ৫০ হাজার টাকায় হচ্ছে। ভাগ হলো এখানে সার্জন, যন্ত্রপাতি, মাইক্রোস্কোপ অনেক কিছু ভিন্নতা রয়েছে, একই লেন্স দিয়ে।
লেন্সের দামগত অনেক তারতম্য রয়েছে। সবচেয়ে কম দামের লেন্স বাজারে পাওয়া যায় ২০০ টাকা করে। আর একটি মাল্টিফোকাল যেটি আমি বলছিলাম, প্রায় ৭০ হাজার টাকা। তাহলে এই দুটো লেন্সের মধ্যে ভেদ অনেক। সুতরাং যত বেশি গুণগত মান ভালো হবে তার দাম তো বেশি হবেই।
প্রশ্ন : যেই রোগীকে দেওয়া হচ্ছে তাকে বুঝিয়ে বলাটাও একটি দায়িত্ব। আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : আমি গতকাল একটি রোগী দেখলাম। আমার এই রোগীর বয়স মাত্র ৩০ বছর। ব্যাডমিন্টন খেলার সময় একটি চোখ আঘাত পেয়েছে। আঘাতের কারণে ছানি হয়েছে।
এখন এই রোগীর জন্য কী করতে হবে? তার অস্ত্রোপচারের পর আমাদের মাল্টিফোকাল লেন্স দিতে হবে। কারণ, তার বয়স হলো ত্রিশের নিচে। যদি আমি সেটি না দেই, লেন্স লাগিয়ে দিলাম, সে দূরে দেখবে, কাছে দেখবে না। তবে একটি মাল্টিফোকাল লেন্সের তো খরচ অনেক। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম। যদি আপনার পক্ষে সম্ভব হয়, আপনার ছেলের জন্য এটা সবচেয়ে ভালো লেন্স হবে। ঠিক পরে যেই রোগীটি আমার কাছে আসল, সে একজন মাল্টি মিলিয়নার। ধনী একজন মানুষ। সে এসে বলল, আমি সবচেয়ে দামি লেন্সটি নেব। মাল্টিফোকাল লেন্স নিতে চাই। আমি তাকে বললাম আপনার চোখে এআরএমডি রোগ রয়েছে। সুতরাং মাল্টিফোকাল লেন্স মানাবে না। তবে আপনার জন্য প্রযোজ্য নয় লেন্সটা। এটা চোখে মানাবে না। আপনার জন্য ভালো হবে স্বাভাবিক লেন্স।
রোগীদের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলতে হবে। আবার রোগীর ক্যাপাসিটিও দেখতে হবে। একজন গরিব মানুষকে বললেন আপনার চোখে মাল্টিফোকাল লেন্স লাগাতে হবে। সেটি বলাই তো ঠিক হবে না। বুঝতে হবে। হয়তো তার পক্ষে ১৫ হাজারের বেশি টাকা খরচ করা সম্ভব নয়। তাকে তো আমি এক লাখ টাকার লেন্সের কথা বলতে পারব না। পারা উচিতও নয়। এই জন্য আমার রোগীর অবস্থা কেমন এবং তার জন্য কোনটা ভালো হবে, দুটো বিষয় বিবেচনায় রেখে সীদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।