বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস : কারণ, প্রতিরোধে করণীয়
বিশ্বজুড়ে আজ পালিত হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ দিবস। উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়, প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৪৪০তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. মো. মাহিদ খান।
বর্তমানে তিনি ইস্পাহানি চক্ষু হাসপাতালের মেডিসিন ও কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : রক্তচাপ কোন পর্যায়ে গেলে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়? উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়?
উত্তর : আসলে উচ্চ রক্তচাপ একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। একে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু কখনো নিরাময় করতে পারি না। একটি হলো সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার। আরেকটি হলো ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেশার। জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল আগে ব্লাড প্রেশারের ক্ষেত্রে বলত, ১৩০/৮০ প্রি-হাইপারটেনশন। এ বছর হঠাৎ করে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলল, একে আমরা স্টেজ ওয়ান হাইপারটেনশন হিসেবে বলব। আগে বলত, ১৪০/৮০ বা ৯০ হলে পর্যায় এক হাইপারটেনশন। হাইপারটেনশন হলো একটি নীরব ঘাতক। এটি স্ট্রোকের একটি প্রধান কারণ।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনির রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপের পেছনে কারণ কী?
উত্তর : উচ্চ রক্তচাপের ৯৫ ভাগ কারণ হলো ইডিওপ্যাথিক। পাঁচ ভাগের ক্ষেত্রে আমরা কারণ জানতে পারি। পারিবারিকভাবে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা ছিল, পাশাপাশি স্থূল হয়ে গেল, এ জন্য তাঁর উচ্চ রক্তচাপটা হলো।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায় কোন কোন বিষয়?
উত্তর : উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আমাদের অবশ্যই জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করতে হবে। কেউ যদি স্থূল থাকে, ওজন কমালে তাঁর উচ্চ রক্তচাপ কমে যাবে। ধূমপান করলে সেটি বন্ধ করতে হবে। কেউ মদ্যপান করলে সেটি কমিয়ে ফেলতে হবে। যাঁরা লবণ বেশি খান, তাদের ব্লাড প্রেশার বেশি থাকে। যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তাঁরা স্থূল হয়ে গেলে ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলে কোনো সমস্যা কি তিনি অনুভব করবেন?
উত্তর : একে আমরা বলি নীরব ঘাতক। স্ট্রোক হয় এই উচ্চ রক্তচাপের কারণে। প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো ধরনের লক্ষণ সে অনুভব করে না। এটি ধীরে ধীরে ব্যক্তির মস্তিষ্ক, হার্ট, কিডনিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তাই বছরে দুবার হলেও চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ব্লাড প্রেশার মাপতে হবে। তবে মাঝেমধ্যে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। কারো যদি হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে যায়, মাথা ঘুরানো বা চোখে কম দেখার সমস্যা হতে পারে। যেমন—অনেক দিন প্রেশার থাকলে হার্টটা বড় হয়ে যায়। হাঁটতে গেলে শ্বাসকষ্ট হয়। এসব লক্ষণ শেষের দিকে তৈরি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ আমরা পাই না। এ জন্য প্রত্যেকেরই উচিত বছরে এক বা দুবার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করা।
প্রশ্ন : অনেকে ভাবেন, উচ্চ রক্তচাপে তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমি ওষুধ খাব কেন?
উত্তর : আসলে বারবার একই কথা বলব। এটি হলো নীরব ঘাতক। উচ্চ রক্তচাপ বেশি থাকলে তাঁর স্ট্রোক হতে পারে। অথবা হেমোরেজ হতে পারে। হার্টে করোনারি আর্টারি ব্লক হয়ে ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ হতে পারে। কিডনিটা অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। এসব রোগ প্রতিরোধের জন্য তাঁকে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আমি একটি জিনিস বলি, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন। হার্টের রোগ, কিডনির রোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করুন, সুস্থ থাকুন।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপ হলে কি সারা জীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হবে? আর এই ওষুধ খাওয়ার কারণে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে কি না?
উত্তর : ওষুধ অবশ্যই তাঁকে খেতে হবে। রোগী যদি বলে, এখন আমার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আসলে এটি তো ওষুধ খাওয়ার কারণে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। রোগীর রক্তচাপ যদি ১৩০/৮০ বা তার নিচে থাকে, তাহলে সে ভালো অনুভব করবে। আর রোগব্যাধি হওয়ার জটিলতা অনেকাংশে কমে যাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওষুধটা খেতে হবে। অতএব, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকে ওষুধটা খেতে হবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেটা হয়, এর চেয়ে লাভটা বেশি।
আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে ওষুধ বদলে দেওয়া হয়। এখন অনেক রকম ওষুধ রয়েছে। আগে তো তিনবার ওষুধ খাওয়া লাগত। এখন সমন্বিতভাবে ওষুধ পাওয়া যায়। দুটো ওষুধ একত্রে পাওয়া যায়। দিনের বেলা বা রাতের বেলা একবার খেলে ২৪ ঘণ্টার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হয়ে আসে।
প্রশ্ন : রক্তচাপ কত দিন পর পর মাপা উচিত? আর যদি বাসায় মাপতে চায়, কী মেশিন ব্যবহার করা ভালো?
উত্তর : সাধারণত চিকিৎসকের কাছে গিয়েই মাপা ভালো। বাসায় যাঁরা মাপেন, তাঁরা সাধারণত ডিজিটাল মেশিন দিয়ে মাপেন। তবে দুই মাস পর পর চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। সঙ্গে যদি অন্যান্য রোগ থাকে, যেমন কিডনির রোগ বা হার্টের রোগ, তাহলে দুই মাস পর পর যাওয়া উচিত। আর কারো যদি উচ্চ রক্তচাপ না থাকে, রুটিন করে চেকআপের ক্ষেত্রে বছরে অন্তত একবার করা উচিত। দুইবার হলে ভালো হয়।
এখন সারা বিশ্বে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস এত বেড়েছে যে প্রতিটি ঘরে কারো না কারো এই সমস্যা রয়েছে। ঘরে মাপতে চাইলে ভালো কাউকে দিয়ে মাপতে হবে।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে একজন রোগীকে কী কী উপদেশ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : সাধারণত দুই ধরনের উপদেশ দিই। একটি হলো, জীবনযাপনের ধরনের পরিবর্তন। এটি হলো ওষুধ ছাড়া। আরেকটি হলো ওষুধের মাধ্যমে। ওষুধ ছাড়া যেটি সেটি হলো তাঁকে জীবনযাপনের পরিবর্তন করতে হবে, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, হাঁটাচলা করতে হবে। নিয়মিত ঘুমাতে হবে। তাঁকে চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। তাঁর যদি ধূমপানের ইতিহাস থাকে এটি বন্ধ করতে হবে। মদ্যপান করার অভ্যাস থাকলে বন্ধ করতে হবে। তাঁকে নিয়মিত হাঁটাচলা করে শরীরের ওজন ঠিক রাখতে হবে। কোলেস্টেরল যদি বেশি থাকে ওষুধ খেয়ে কমাতে হবে।
আর ওষুধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ওষুধ পাওয়া যায়; সিঙ্গেল ডোজে বা সমন্বিতভাবে। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে খুব সহজে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে আনা যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীদের ক্ষেত্রে রেজিসটেন্স হাইপারটেনশন পাওয়া যায়।
কিডনি রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তাঁদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা একটু কঠিন হয়ে যায়।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খাচ্ছেন এমন কোনো রোগীর হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেলে করণীয় কী?
উত্তর : আমরা একে সাধারণত দুইভাগে ভাগ করি। হাইপারটেনসিভ ইমার্জেন্সি, হাইপারটেনসিভ আর্জেন্সি। হাইপারটেনসিভ ইমার্জেন্সি বলতে বোঝায় তাঁর সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার দুইশ বা তার ওপরে হয়ে গেছে, ডায়াস্টোলিক প্রেশার ১৩০ বা তার উপরে হয়ে গেছে। এর সঙ্গে যদি মাথা ঘুরানো বা চোখে অন্ধকার দেখা বা বুকে ব্যথা হওয়া, কিডনি ফেইলিউর হওয়ার সমস্যা হয় তখন আমরা হাইপারটেনসিভ ইমার্জেন্সি বলি। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি করে ১৪০/৯০ এ রকম অবস্থায় আনতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে কমাতে হবে।
হাইপারটেনসিভ আর্জেন্সি বলতে বোঝায়, তাঁর রক্তচাপ বেশি রয়েছে, উপরেরটা হয়তো ২০০ রয়েছে, নিচেরটা হয়তো ১১০/ ১২০ রয়েছে। কিন্তু তাঁর কোনো লক্ষণ নেই। এসব ক্ষেত্রে ওষুধ দিয়ে বাসাতে চিকিৎসা করা সম্ভব।
এ ক্ষেত্রে ওষুধের ডোজ সমন্বয় করে নিতে হবে। যেই ডোজ খাচ্ছেন, একে ডাবল করে নিতে পারেন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।
প্রশ্ন : কোন কোন খাবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের এড়িয়ে যাওয়া উচিত?
উত্তর : ডায়াবেটিসের মতো উচ্চ রক্তচাপের রোগীদেরও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। ফল বেশি খেতে হবে। কার্বহাইড্রেট কম খেয়ে সবজি বেশি খেতে হবে। যদি বেশি ওজন থাকে অবশ্যই ওজন কমাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে।