হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ প্রতিরোধে করণীয় কী?
আজ বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। হেপাটাইটিস প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে আলোচনা করেছেন অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব।
বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৫০৫তম পর্বে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : ভাইরাল হেপাটাইটিসকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী?
উত্তর : আমরা আসলে বিশেষজ্ঞরা যে রোগ নিয়ে কথা বলি, সাধারণ মানুষ একটু দ্বিধান্বিত হয়ে যায়। ‘বি’ ভাইরাস ও ‘সি’ ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে পৃথিবীতে প্রতি ১২ জন মানুষের মধ্যে একজন হয় হেপাটাইটিস ‘বি’, না হলে হেপাটাইটিস ‘সি’-তে আক্রান্ত থাকে। কারণ, যারা পৃথিবীতে আক্রান্ত, তাদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ জানে, তাদের এটি আছে। ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ লোকের ধারণাই নেই, তাদের শরীরের রোগটি বাসা বেঁধে রয়েছে। কেউ হয়তো ক্যারিয়ার, কেউ হয়তো সক্রিয়।
দ্বিতীয় বিষয় দাঁড়াচ্ছে, আমরা যদি সক্রিয় রোগের বাহকই হই, তাহলে আমি টের পাচ্ছি না কেন। এর উত্তর হলো, এই যে যারা সক্রিয় রোগে আক্রান্ত, তাদের কারো কারো একসময় লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। লিভার সিরোসিস হয়ে লিভারটা ফেল না করা পর্যন্ত, লিভার ক্যানসার না হওয়া পর্যন্ত অধিকাংশ লোকেরই কোনো লক্ষণ থাকে না। এখন আমরা জানি, পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩০০ মিলিয়ন বা ৩৫ কোটি লোক হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত। বিশেষ করে এশিয়ার প্রধান অঞ্চলগুলো হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের একটি বড় জায়গা। আমাদের দেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রায় ৬০ শতাংশ লিভার সিরোসিস, ৬০ শতাংশের বেশি লিভার ক্যানসার হচ্ছে শুধু হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের কারণে। এই যে বিপুলসংখ্যক নাগরিক, যারা হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত, এদের একটি বড় অংশ প্রতিবছর খারাপ রোগের দিকে বা খারাপ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বছরে মারা যাচ্ছে ২০ হাজার জন। এটা কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ। এটা কিন্তু ডায়াবেটিস নয়, এটা কিন্তু ক্যানসার নয়। এটা কিন্তু হার্ট অ্যাটাক নয় যে হয়ে গেছে চিকিৎসা ছাড়া গতি নেই। এটি যদি আমরা ঠেকিয়ে দিতে পারি, তাহলে পৃথিবীর স্বাস্থ্য খাত একটি বড় বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাবে। এ রোগ প্রতিরোধযোগ্য। কেউ আক্রান্ত হয়ে গেলে চিকিৎসা করে নিরাময়যোগ্য।
এই গ্লোবাল ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবেই কয়েক বছর ধরে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত হাতেগোনা যে পাঁচ ছয়টি দিবস রয়েছে, এর মধ্যে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস একটি।
প্রশ্ন : এ বছর মূল প্রতিপাদ্য কী?
উত্তর : এ বছরের প্রতিপাদ্য ফাইন্ড আউট দ্য মিসিংস মিলিয়নস। ‘আসুন, খুঁজি লক্ষ অজানা রোগীদের’। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, ২০৩০-এ যে মিলেনিয়াম সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলগুলো সেট করা হয়েছে, এ সাসটেইনবল গোলের দুটো টার্গেট ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটা টার্গেট হলো, ২০৩০-এর মধ্যে ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে হবে। লিভার ক্যানসারকে নির্মূল করতে হবে। এ জন্য কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে বৃহৎ ক্যাম্পেইন চলছে। আমার মনে হয়, গত এক-দুই বছর দৃশ্য পরিবর্তন হচ্ছে। এর আগ পর্যন্ত কিন্তু কিছু লিভার বিশেষজ্ঞ, কিছু সংগঠন আর আমাদের সরকারের কিছু পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে কার্যকর উদ্যোগ ছিল না। কয়েক বছর ধরে দৃশ্যটা পরিবর্তন হয়েছে। এখন অনেক কথা হচ্ছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রশ্ন : যারা ক্যারিয়ার, সমস্যাটা জানেন না, তাদের খুঁজে বের করার উপায় কী?
উত্তর : অনেক উপায় রয়েছে। এই যে আজ আমরা আলোচনা করছি, এটিও একটি উপায়। আমাদের দেশ কিন্তু এদিকে পথিকৃৎ। আমাদের দেশ এ অঞ্চলের মধ্যে প্রথম দেশ, যারা হেপাটাইটিস ‘বি’র ভ্যাকসিনেশন আমাদের ইপিআই শিডিউলে যোগ করেছিলাম। আমাদের সাফল্যের হারটা বহু বছর ধরে ৯০ ভাগ প্লাস। আমরা ধরে নিতে পারি যে আজকে যে নাগরিকের বয়স ৫০ বছর, অন্তত হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ তৈরি হয়ে গেছে। যে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশের নাগরিক রয়েছেন, জানাতে হবে, আমাদের একটি রোগের সংক্রমণ থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। যদি না থাকের পরীক্ষা করে টিকা নিয়ে নেন। যদি থেকে থাকেন, তাহলে চিকিৎসাটা নেন। এটি হলো একটি উপায়। আরেকটি হলো বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে, তাদের প্রতি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জায়গাতে যেখানে জনসমাবেশ থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা একটি অফিস, সেখানে গিয়ে যদি ক্যাম্পেইনগুলো করা হয়, সেটি খুঁজে বের করার জন্য। এটি খুঁজে বের করা হচ্ছে। আমাদের প্রতিরোধ করতে হলে, রাষ্ট্রের অবশিষ্ট নাগরিককে কিন্তু ভ্যাকসিনেশন করতে হবে।
এটি একটি উপায়। আমরা যেভাবে বলছিলাম, আলোচনাগুলো একটি উপায়।
প্রশ্ন : খুঁজে বের করার জন্য স্ক্রিনিংয়ের কোনো পরামর্শ রয়েছে কি? বা ব্যাপকভিত্তিক জনসংখ্যার মধ্যে সেই স্ক্রিনিংটা কীভাবে করা যায়?
উত্তর : কেবল রোগ নির্ণয় নয়, এর জন্য চিকিৎসাকে সহজলভ্য করতে হবে। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ দুটো ভাইরাসের স্ক্রিনিং কিট রয়েছে। স্ক্রিনিং টেস্ট করলে আপনি জানতে পারবেন, একটি পজিটিভ রিপোর্ট, একটি নেগেটিভ রিপোর্ট। বোঝা যাচ্ছে যদি নেগেটিভ রিপোর্ট থাকে, তাহলে আপনি প্রায় শতভাগ নিশ্চিত। এ রোগ আমার শরীরে নেই। যদি আপনার পজিটিভ থাকে রিপোর্ট, তাহলে আপনার আবার পরীক্ষা করে, নিশ্চিত হতে হবে, আসলেই আপনার রোগটা আছে, নাকি নেই। ‘বি’ ভাইরাসের ক্ষেত্রে সাধারণত এইচজিএস এজি বলে একটি পরীক্ষা করা হয়। আরো পরীক্ষা রয়েছে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এটাই। আর ‘সি’ ভাইরাসের ক্ষেত্রে আমরা একটি অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করি। অ্যান্টিএইচসিজি।
প্রশ্ন : এ দুটো কেউ যদি নিজ উদ্যোগে ইউনিয়ন লেভেল পর্যন্ত যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে থাকেন, সেখানে কি এর চিকিৎসা করা সম্ভব?
উত্তর : আমরা যেটি মোটামুটি দেখি, এইচবিএসসি অ্যান্টি অ্যাজিং স্ক্রিনিং পরীক্ষাগুলো উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কিন্তু যেটি নিশ্চিত হওয়ার পরীক্ষা, সেটি এখনো পৌঁছায়নি। তবে আমার কাছে যেটি মনে হয়, আমাদের যে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো রয়েছে, সেখানে হয়তো আমরা পরীক্ষাটা সচরাচর করতে পারব না। কিন্তু সচেতনতামূলক পোস্টার ডিস্ট্রিবিউশন করতে পারব।
বাংলাদেশে যেকোনো জেলা পর্যায়ে এটি করে নেওয়া খুব সম্ভব। এটি খুব বেশি ব্যয়বহুলও নয়।
প্রশ্ন : হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস প্রতিরোধে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : একটি হলো, আমি যদি আক্রান্ত হতে না চাই, আমাকে জানতে হবে, আমি কীভাবে আক্রান্ত হবো না। পাশাপাশি আর্থসামাজিক কারণে আমাকে জানতে হবে, কীভাবে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ছড়ায় না।
দেখুন, এ দুটোই কিন্তু রক্তবাহিত ভাইরাস। দূষিত রক্ত কোনোভাবে যেন আমার রক্তে না মেশে, আমি কিন্তু কখনো হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হবো না। এটা ভেবে কিন্তু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার কারণ নেই। আমি ভাবতে পারি, আমরা যেহেতু রক্ত নিইনি, আমাদের ভয় নেই। কিন্তু বুঝতে হবে, এ ভাইরাসগুলো বিভিন্নভাবে রক্তে মিশতে পারে।
যেমন, নাপিতের দোকান। সেভটা সেলুনে করে। সেখানে যে রেজার ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে যে ব্লেডটা ব্যবহার করা হয়, যদি ডিসপোসেবল ব্লেড না হয়, নাপিতের ক্ষুরে আমার গালটা একটু কেটে গেল, সুতরাং ক্ষুরে লাগল। এই ক্ষুরটি পানিতে ধুয়ে যদি আপনার গালটিও সেভ করে, আপনার গালও যদি কেটে যায়, আপনি কিন্তু ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন।
একইভাবে নাক বা কান ফোঁড়ানো এসব থেকে কিন্তু সমস্যা হতে পারে। আরেকটি হলো, রক্ত পরিসঞ্চালনের সময়, রক্তকে অবশ্যই পরীক্ষা করে নিতে হবে। এটাও এখন অনেকখানি মানে। আসলে জায়গাটা হতাশার নয়, সম্পূর্ণ না হলেও প্রক্রিয়াটা চলছে। আসলে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কীভাবে ভাইরাসটা হয়েছে জানা।
আর আমি যদি কারো সঙ্গে কোলাকুলি করি, আমি যদি ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে একই ওয়াশরুমে গোসল করি কিংবা একই গ্লাসে পানি পান করি, একই প্লেটে ভাত খাই, বসে আড্ডা মারি, আমার কিন্তু ‘বি’ ভাইরাস বা ‘সি’ ভাইরাস ছড়াবে না। জানা অত্যন্ত জরুরি এই কারণে যে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে দেখি অনেক আর্থসামাজিক জটিলতা দেখা দেয়। এই জিনিসগুলোর ক্ষেত্রেও খুব স্বচ্ছ ধারণা আমাদের রাখতে হবে।