ডায়াবেটিস হলে কিডনির কী সমস্যা হয়?
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিডনির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ডায়াবেটিস থেকে কিডনি অকেজো পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
ডায়াবেটিস হলে কিডনির কী সমস্যা হয়, এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৫৩৮তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. শামীম আহমেদ। তিনি জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের নেফ্রোলজি বিভাগের পরিচালক ও অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিসের সঙ্গে কিডনি রোগের সম্পর্ক কী?
উত্তর : আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন কিন্তু ক্রনিক কিডনি ফেইলিউর বা দীর্ঘ মেয়াদি কিডনি অকেজো হওয়ার কারণ ছিল নেফ্রাইটিস বা ব্লাড প্রেশার। এখন ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের প্রথম কারণ হলো ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস থেকে কিডনির রোগটি কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্য হয় না। যদি ১০০টি লোকের ডায়াবেটিস থাকে, এর মধ্যে ৪০ থেকে ৫০টি লোক কিডনি রোগে ভুগবে। আর ৫০ জনের হয়তো ওই পর্যায়ে যায় না।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস রোগীর কিডনি রোগ হয়েছে কীভাবে বোঝা যাবে?
উত্তর : যদি রোগী ডায়াবেটিসটা নিয়ন্ত্রণে রাখে তাহলে কিডনি রোগের ঝুঁকিটা কম। ডায়াবেটিস রোগীর কিডনি রোগের পাঁচটি পর্যায় সম্পর্কে একটু বলি। প্রথম পর্যায়ে ডায়াবেটিস হলে কিডনিটা একটু বড় হয়ে যায়। ফিল্টেশন বেশি হয়। এটি প্রথম পর্যায়। এই পর্যায়ে চার থেকে পাঁচ বছর থাকার পর যদি সমস্যাটি বেড়ে যায়, তখন দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করে। একে বলে নীরব পর্যায়। এখানে কিডনিতে কোনো পরিবর্তন হবে না।
এর পরের পর্যায়টি বিপজ্জনক। তখন আমরা কিন্তু ধরতে পারি। আগে আমরা প্রোটিন বলতাম। এখন প্রোটিন বলি না, বলি মাইক্রো অ্যালবুমিন। প্রোটিন যাওয়ার আগেই এই জিনিসটি নির্ণয় করা যায়। মাইক্রো অ্যালবুমিন দেখলে আমরা বুঝতে পারি তৃতীয় পর্যায়।
প্রশ্ন : ইউরিনে অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না সেটি বোঝার উপায় কী?
উত্তর : না, আপনি কিছু বুঝতে পারবেন না। আপনার ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ ভালো, আপনার ব্লাড প্রেশার নেই, কিডনির সমস্যা নেই, চোখের সমস্যা নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে ওই পরীক্ষাটা বছরে একবার করলে বোঝা যাবে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরতে পারলে কিন্তু সেটি ভালো করা যায়। কিছু ওষুধ দিলে কিডনিটা ঠিক হয়। আর সবচেয়ে বড় হলো সচেতনতা। আপনি জানলেন যে আপনার প্রস্রাবে মাইক্রো অ্যালবুমিন যাচ্ছে। এই পর্যায়ে ব্লাড প্রেশার বাড়ে, এই পর্যায়ে জিএফআর কমে যায়। আপনার ব্লাড প্রেশারটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ডায়াবেটিসটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তৃতীয় পর্যায়ের পরে যে চতুর্থ পর্যায় সেটি হলো অতিরিক্ত প্রোটিন যাওয়া। তখন আর মাইক্রো অ্যালবুমিনের গুরুত্ব নেই। এটা অনেকে ভুল করে।
ডায়াবেটিস রোগীর নেফ্রোটিক সিনড্রমের চিকিৎসা করা যে কত জটিল, আমরা যারা কিডনি বিশেষজ্ঞ তারা জানি। কিছুতেই পানি কমানো যায় না। আর ওই রোগীকে ভালো করা খুব কঠিন।
পঞ্চম পর্যায়ে এসব সমস্যার সঙ্গে ক্রিয়েটিনিন বাড়া শুরু করবে। ভয়ের কিছু নেই। এই পর্যায়ে আসতে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ বছর লাগে। গবেষকরা গবেষণা করে এই পর্যায়গুলো ভাগ করেছেন।
যদি আমরা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখি, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখি, তাহলে কিন্তু আমরা এই রোগের মুখোমুখি হবো না। নিয়মানুর্ব্তী জীবন যাপন করতে হবে। প্রথমে আমরা বলি আপনি ডায়েট ও ব্যায়াম করেন। এরপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মুখে ওষুধ খাওয়া। এরপর রয়েছে বিভিন্ন ইনসুলিন। মোটকথা হলো, রক্তের সুগারটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
এখন সমস্যা হলো, যখন এ কিডনিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, যখন ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যায়, তখন কিছু কিছু ওষুধ আমাদের দিতে হবে। যখন ক্রিয়েটিনিন তিন/ চার হবে, তখন কিন্তু ইনসুলিনের পরিমাণ কম লাগে। যাদের দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ রয়েছে, তাদের কিন্তু দেখবেন যে ইনসুলিনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তখন যদি ইনসুলিন বেশি নেয়, তাহলে হাইপো হয়ে যাবে। বুক ধরফর করবে, ঘাম হবে।
যখনই কিডনি যুক্ত হবে, তখন অন্যান্য অঙ্গ যুক্ত হবেই। চোখে রেটিনোপ্যাথি হবে। হার্ট যুক্ত হবে। পরপর অনেক অঙ্গযুক্ত হবে। অনেকে রয়েছে যাদের দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস রয়েছে তবে কিছু হচ্ছে না। আবার অনেকে রয়েছে, যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস তাদের খুব দ্রুতই সমস্যা হচ্ছে।
আরেকটি হলো, ডায়াবেটিস থাকলে যে সংক্রমণ সেটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। ডায়াবেটিস যখন থাকে, তখন হার্টের সমস্যা থাকে, এর মধ্যে প্রস্রাবে ইনফেকশন। ইনফেকশন আমরা কালচার করে অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছি। অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিকও রেজিসটেন্স হয়ে যায়।
যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের বলতে চাই, তারা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখেন, ব্লাড প্রেশারটা নিয়ন্ত্রণ করেন, একটি কায়িক পরিশ্রম করেন, সংক্রমণ থাকলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করেন, আর যত্রতত্র ওষুধ খাবেন না। যাদের বয়স বেশি, তাদের হয়তো গিঁড়ায় ব্যথা হঠাৎ করে কাউন্টার থেকে কিনে ওষুধ খেয়ে ফেলল। এটি কিডনির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
এই ব্যথানাশক ওষুধগুলো সুস্থ রোগীর ক্ষতি করবে না, যাদের সামান্যতম কিডনির সমস্যা রয়েছে, যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে অথবা যাদের বয়স বেশি বা যাদের শরীরে পানি রয়েছে, তাদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। আসলে ত্রিশের পরে যখন বয়স বাড়তে থাকে প্রত্যেক ১০ বছর বয়সে আমার ইজিএফআর কমে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : ইজিএফআর কী?
উত্তর : ইফেকটিভ গ্লুমেরু ফিল্টেশন রেট। মানে কিডনি ফাংশনটা কতটুকু সেটি বলতে পারবে। যখন বয়স ত্রিশ তখন ইজিএফআর খুব ভালো থাকবে। যখন বয়স ৭০ থাকবে তখন কিডনির ফাংশন ৩০ ভাগ এমনিতেই কমে যাবে।