স্তন ক্যানসার : লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
অক্টোবর স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস। এ মাস পুরোটা জুড়েই এ বিষয়ে কাজ করা হয়। স্তন ক্যানসারের বিভিন্ন বিষয় নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
স্তন ক্যানসারের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের বিষয় এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৫৭২তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. সাজিয়া সাজমিন সিদ্দিকা। বর্তমানে তিনি সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : অক্টোবর হলো স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস। স্তন ক্যানসার সচেতনতা নিয়ে মাসজুড়ে এত কেন আয়োজন?
উত্তর : আসলে স্তন ক্যানসারের প্রকোপ দিন দিন অনেক বেড়ে চলেছে। এখন নারীদের ক্ষেত্রে এক নম্বর ঘাতকব্যাধি হলো স্তন ক্যানসার। দেখা যায়, প্রত্যেক নারীরই ঝুঁকি রয়েছে এই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার। যদিও একটি মাস ধরে সচেতনতা পালন করা হয়, তবে সারা বছরই সচেতন থাকা উচিত। কাজেই কেবল একটি দিন সচেতনতা পালন করা একদম যুক্তিযুক্ত নয়।
এর উৎস কিন্তু ছিল আসলে অনেক বছর আগে। একটি কোম্পানি শুরু করেছিল ব্রেস্ট ক্যানসার অ্যাওয়ারনেস মাসটা। ওরা একটি ওষুধের ক্যাম্পেইন হিসেবে এটা শুরু করেছিল। এরপর এটি আস্তে আস্তে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেল। সে সময় থেকে পিংক অক্টোবর বলে একটি থিম চালু হয়েছিল। এখন অনেক জায়গায় পিংক রংটি ব্যবহার করা হয়।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার বলতে কী বোঝানো হয়?
উত্তর : শরীরের যেকোনো জায়গায় কোনো কোষের বিভাজন একটি নীতি মেনে হয়। যখন কোনো কোষ কোনো নিয়মকানুন মানে না, তখন সেখানে অনিয়মিতভাবে একটি বিভাজন শুরু হয়। তখনই সেখানে আসলে ক্যানসার তৈরি হয়। ক্যানসারটা প্রথমে একটি চাকা তৈরি করে। এই চাকাটা অনুভব করা যায়। তো, স্তন ক্যানসারও তেমন; স্তনের মধ্যে প্রথমে একটি ছোট চাকা তৈরি হয়, এটা হয়তো হাতে লাগে না, কিন্তু এটা ভেতরে থাকে। এটা ম্যামোগ্রামের মাধ্যমে বা বিভিন্ন ইমেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে দেখা যায়। হাত দিয়ে বোঝার আগেই নির্ণয় করা যায়।
এ জন্য স্ক্রিনিংটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি মাসে সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন করতে হবে।
স্ক্রিনিং প্রোগ্রামটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমে হলো, সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন। এটি প্রতি মাসে করতে হবে। ডাক্তার করবেন। এ ছাড়া প্রতিবছর বা তিন বছর পর পর ম্যামোগ্রাম বা আলট্রাসনোগ্রাম করতে হবে। এই তিনটি পর্যায়েই আসলে করা হয়। তবে আমরা যেটির ওপর বেশি গুরুত্ব দিই, যেটির ক্ষেত্রে কোনো রকম পয়সা খরচ হয় না, সেটা হলো নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করা।
প্রশ্ন : সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন কখন করতে হবে? কাদের মাধ্যমে এটি শেখা যাবে?
উত্তর : এখন তো আমরা শেখাচ্ছি। যাঁরা মেডিকেল পারসন, বিশেষ করে ব্রেস্ট সার্জন, নার্স তাঁরা কাজটি করছেন। আর এখন যেহেতু প্রযুক্তির যুগ, ইন্টারনেট রয়েছে। একটু খুঁজলে অনেক কনটেন্ট পাওয়া যাবে সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশনের।
২০ বছর পর থেকে শুরু করে প্রতিবছর একদিন, যাদের ঋতুস্রাব হয়, তাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব শুরুর পাঁচ থেকে সাত দিন পরে এবং যাদের ঋতুস্রাব হচ্ছে না, অথবা যারা গর্ভবতী তাদের ক্ষেত্রে মাসের একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে নিয়ে প্রতি মাসের ওই দিন ১০ মিনিট সময় খরচ করে চার থেকে পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করে নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করবে।
সবচেয়ে জরুরি যে জিনিসটা নিজের স্তনের স্বাভাবিক আকারকে চিনতে হবে। যাতে উনি যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের স্তন দেখতে হবে। এটা রোগ নির্ণয়ের জন্য জরুরি।
আমাদের দেশের আসলে সামাজিক অবস্থাটা এ রকম যে আমরা কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পাই। যেমন এর মধ্যে স্তন একটি। কোনো মেয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে, স্বামীর সঙ্গে, এমনকি প্রতিবেশী নারীর সঙ্গেও কিন্তু স্তন নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পায়। দুই নম্বর হলো ভয়। তিন নম্বর অর্থনৈতিক বিষয়।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার ধরা পড়লে কীভাবে ব্যবস্থাপনা করেন এবং প্রতিরোধ করেন?
উত্তর : ২০ বছর বয়স থেকে অবশ্যই স্ক্রিনিং শুরু করতে হবে। প্রতি মাসে একবার করে নিজের স্তন পরীক্ষা করতে হবে। বিপজ্জনক যেসব চিহ্ন রয়েছে, সেগুলো দেখলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এর মধ্যে এক নম্বর হলো স্তনে চাকা। যে চাকাটার কোনো আকার পরিবর্তন হয় না। আবার কিছু কিছু চাকার আকার পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই আমরা বলি, চাকা মনে হলেই চিকিৎসকের কাছে যান। দুই নম্বর হলো, চামড়া কুঁচকে যায়। বা কুঁকড়ে থাকে বা ভেতরে ডেবে থাকে। যদি নিপল থেকে অস্বাভাবিক নিঃসরণ হয়, বিশেষ করে যদি রক্ত বের হয় হঠাৎ করে, নিপলের পাশে যদি শুকনো খসখসে হয়ে যায়, ফুসকুড়ির মতো দেখা যায়, এরপর যদি অস্বাভাবিকভাবে লাল হয়ে থাকে বা ফুলে থাকে, এমনকি যদি দেখা যায় একটি স্তন থেকে আরেকটি স্তনের আকার পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, অথবা যদি বগলের নিচেও ফোলা থাকে, বিশেষ করে সেগুলোতে যদি ব্যথা না থাকে, তাহলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
স্তন ক্যানসারে যে কোনো ব্যথা হয় না, এ জন্যও কিন্তু রোগীরা দেরি করে আসে।
প্রশ্ন : কোন পর্যায়ে চিকিৎসা কীভাবে দিয়ে থাকেন?
উত্তর : স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা করার আগে ক্যানসারটি কোন পর্যায়ে রয়েছে, এটি নির্ণয় করা হয়। স্তন ক্যানসারকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে দুটোকে প্রাথমিক পর্যায় ও দুটোকে অগ্রবর্তী পর্যায় হিসেবে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক যে পর্যায়, সেগুলোকে সাধারণত প্রথমে সার্জারি করা হয়। সার্জারির মধ্যে ব্রেস্ট কনজারভেশন সার্জারি ইদানীং খুব জনপ্রিয়। যদি দেখা যায়, চাকা ফেলে দিয়ে স্তন রেখে দিলে তার জন্য উপকার হবে, তাহলে সেটাই চেষ্টা করা হয়।
আর যখন দেখা যায়, অগ্রবর্তী পর্যায় চলে গেছে, তখন সাধারণত প্রথমে কেমোথেরাপি অথবা রেডিওথেরাপি শুরু করা হয়। অথবা যেসব ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রবর্তী পর্যায় সেসব ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। পরে অন্যান্য চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে হরমোন থেরাপিও রয়েছে।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে পরামর্শ কী?
উত্তর : নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করুন এবং আপনার আশপাশে যে নারী রয়েছে, তাদের সচেতন করুন। সেটা হতে পারে আপনার বন্ধ, আপনার আত্মীয়স্বজন, হতে পারে আপনার গৃহকর্মী। গৃহকর্মীরও কিন্তু অধিকার রয়েছে সুস্থ থাকার।