স্তন ক্যানসারের লক্ষণ কী, প্রতিরোধে করণীয়
সারা বিশ্বে প্রতি আটজনের মধ্যে একজন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। স্তন ক্যানসারের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। অক্টোবর মাস স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস।
স্তন ক্যানসারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৫৮০তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেন। বর্তমানে তিনি স্কয়ার হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসারকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
উত্তর : পৃথিবীব্যাপী মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো স্তন ক্যানসার। এর মধ্যে সারা পৃথিবীতে ৩৬ জনের মধ্যে একজন স্তন ক্যানসারে মারা যান। প্রতি আটজনের একজন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আমাদের দেশেও কিন্তু এর হার অনেক বেশি। মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্তন ক্যানসার হয়। এতে মৃত্যুর হারও অনেক। আমরা যেটা জানি, সেটি হলো মেয়েদের স্তনে হয়। তবে এটি ছেলেদেরও হতে পারে, মেয়েদেরও হতে পারে। ছেলেদের হলো তিন ভাগ আর মেয়েদের মধ্যে ৯৭ ভাগ।
কখনো দেখা যাচ্ছে, বোঁটা থেকে রক্তপাত হচ্ছে বা কোনো জায়গায় চামড়া উঠে গেছে বা কোনো রস নির্গত হচ্ছে। চামড়া বা ত্বক কমলালেবুর খোসার মতো হয়ে যাচ্ছে অথবা পিণ্ড পাওয়া যাচ্ছে। শক্ত পিণ্ড যদি পাওয়া যায় এবং দেখা যায় একটি জায়গাতেই পাওয়া যায়, তাহলেও বুঝতে হবে এর আশঙ্কা রয়েছে। তাহলেও চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার হওয়ার পেছনে কারণগুলো কি জানা গেছে? সেগুলো কী?
উত্তর : অন্যান্য ক্যানসারের ক্ষেত্রে আমরা যেমন সুনির্দিষ্ট ক্যানসার পাই, এ ক্ষেত্রে কিছু কারণ আমরা জানতে পারি। আমরা বলি, এর পেছনে একটি পারিবারিক কারণ রয়েছে। মা, খালা, দাদি, নানির মধ্যে যদি স্তন ক্যানসার থাকে, এটি একটি কারণ হতে পারে। স্থূলতাকে একটি কারণ বলা যায়। ওজন বেশি হলে চর্বি থেকে ইসট্রোজেন তৈরি হয়। ওজন বেশি হওয়া স্তন ক্যানসারের একটি বড় কারণ। যাঁরা ইসট্রোজেন থেরাপি নিয়ে থাকেন বা চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, তাঁদের সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া ঋতুস্রাব যদি ১২ বছরের আগে শুরু হয়, মেনোপজ যদি ৫৫ বছরের পরে হয়, ৩৫ বছরের পরে যদি বাচ্চা নেওয়া হয়—এসব কারণে স্তন ক্যানসার হতে পারে।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসারে সচেতনতার ক্ষেত্রে কী কী বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন?
উত্তর : স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে আমরা বলি, এটিই হলো অন্যতম ক্যানসার, যেটি আমরা আগে থেকে ধরতে পারলে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা দিলে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব। একটি হলো, আমরা যদি গোসলের সময় স্তন পরীক্ষা করি, বিশেষ করে সাবান লাগানোর পরে ডান হাত দিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টা করি, হাতের তালু বা আঙুল একসঙ্গে দিয়ে, তাহলে কিন্তু আমরা কোনো পিণ্ড বা চাকা দেখতে পারি, যেটি শক্ত। তাহলে কিন্তু আমরা চিকিৎসকের কাছে যাব। এই একটা করতে পারি গোসলের সময়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও আমরা এটি করতে পারি। অথবা শুয়েও কিন্তু আমরা এভাবে করতে পারি। এটা যদি আমরা করি, তাহলে আমরা সহজে ধরতে পারব যে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে কি না।
প্রশ্ন : কখন থেকে স্ক্রিনিং করা প্রয়োজন?
উত্তর : ৪০ বছরের নিচে হলে আমরা বলি, আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে পরীক্ষা করতে। আর ৪০-এর ওপরে বয়স হলে আমরা মেমোগ্রাম করতে বলি। এখন সাইনোমেমোগ্রাফি রয়েছে। মেমোগ্রাফি ও আলট্রাসনোগ্রাফি একসঙ্গে করে বায়োপসি পর্যন্ত একই সেটিংয়ে করা সম্ভব। এটি করলে আমরা কিন্তু দ্রুত ধরতে পারি। যাদের পরিবারের মানুষের মধ্যে স্তন ক্যানসার রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এমআরআই আগেও করতে পারি আমরা। এটা যে চল্লিশ বছরের পরেই করতে হবে, তা নয়। যাঁরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাঁরা একটু আগেও করতে পারেন। রিপ্রোডাকটিভ বয়সে এটি যেকোনো সময়ই করা সম্ভব। আরেকটি প্রক্রিয়া হলো এমআরআই। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনেক সময় নির্ণয় করা সম্ভব।
প্রশ্ন : নিশ্চিত হওয়ার পরে পদক্ষেপ কী থাকে?
উত্তর : সাধারণত আমরা দেখেছি প্রাথমিক পর্যায়ে যদি কোনো স্তন ক্যানসারের রোগী ধরা যায়, আমরা বলি ৯০ ভাগ রোগীর বেশি সুস্থ করা সম্ভব।
আমার কাছেই এমন রোগী রয়েছে ২৩ বছর ছিল, সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছে। প্রথমে শল্যচিকিৎসা ছিল, কেমোথেরাপি পেয়েছে। হরমোনথেরাপি পেয়েছে, এমন রোগীরাও সুস্থ রয়েছে। যদি অন্য কোনো জায়গায় ছড়িয়ে যায়, সে সময় কিন্তু লম্বা সময় সারভাইভেল দেওয়া কঠিন। এটা নির্ভর করে কোন পর্যায়ে রোগী আমাদের কাছে আসছে, তার ওপর।
স্তনের বাইরে গেল কি না, বোগলের মধ্যে লসিকা গ্রন্থিতে গেল কি না। এটা অন্য জায়গায় ছড়িয়ে গেল, হাড়ে ছড়াল, ফুসফুসে ছড়াল, অনেক সময় মস্তিষ্কেও ছড়ায়। তখন আমরা একে পর্যায় চার বলি। পর্যায় চারের রোগীগুলোকে আমরা ভালো রাখার চেষ্টা করি। তো এটি সব সময় ১০০ ভাগ নিরাময়যোগ্য নয়।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন কি সবার ক্ষেত্রে হয়?
উত্তর : প্রাথমিক পর্যায়ে আসলে একে আমরা বলি লাম্পেক্টোমি। লাম্পেক্টোমি করার পর রোগীকে সাধারণত লেশনথেরাপি দিলে রোগী ১০০ ভাগ ঠিক থাকে। আবার কোনো কোনো সময় রোগীর সম্পূর্ণ স্তনটাই কেটে ফেলতে হয়। কেমোথেরাপি দিতে হয়। কেমোথেরাপি দেওয়ার পর যারা উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, তাদের নিওএডজোভেন কেমোথেরাপি দিই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ ভাগ ভালো হয়ে যায়।
স্বাভাবিক রোগীর কেমোথেরাপি আমরা তিন সপ্তাহ পর পর চার সাইকেল করে দিয়ে থাকি। অথবা যদি সেটি হারসেপটিন পজিটিভ হয়, তখন তার প্রায় এক বছর পর্যন্ত হারসেপটিন নিতে হয়।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা কী রয়েছে?
উত্তর : আমি মনে করি, স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে কোনো রোগীর বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই।
আসলে আমাদের দেশে স্তন ক্যানসারের সব চিকিৎসা রয়েছে। শল্যচিকিৎসা রয়েছে। ভালো মানের কেমোথেরাপি আমাদের দেশে পাওয়া যায়, হরমোনথেরাপিগুলো পাওয়া যায়। অ্যান্টিবডিগুলো বিশ্বমানের রয়েছে। আমরা এখন বিশ্বমানের সেবা দিতে পারি। রেডিয়েশনথেরাপিও আমরা বিশ্বমানের দিতে পারি। কোনো জায়গাতেই কোনো ফাঁক আমার চোখে পড়ছে না।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য কী করা যায়?
উত্তর : সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো, আমরা যদি নিজেরা নিজেদের স্তন পরীক্ষা করি। সঠিক মাপে ওজন রাখতে হবে। তিন নম্বর হলো প্রতিদিন ব্যায়াম করা। শাকসবজি ফলমূল যদি বেশি করে খাই, তাহলে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে কী ধরনের খাবার খেতে হবে?
উত্তর : অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেসব খাবারে থাকে সেসব খাবার খেতে হবে, যেমন : শাকসবজি। আমরা আজকাল বেশিরভাগ মানুষই শাকসবজি খাই না। ফাস্টফুডের প্রতি অনেক ঝুঁকে গেছি। কিন্তু শাকসবজি আমাদের খাদ্যাভ্যাসের একটি প্রধান অংশ হওয়া দরকার। তাহলে আমাদের ওজনও ঠিক থাকবে এবং ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব থেকে সহজে বাঁচতে পারব।
প্রশ্ন : ছেলেদের স্তন ক্যানসার কীভাবে বোঝা যাবে?
উত্তর : ছেলেদেরও স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের বিষয়টা সে রকম। মেয়েরা যেভাবে পরীক্ষা করে, ছেলেদের পরীক্ষার পদ্ধতিও একই রকম। আমরা যেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই, সেটি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা। তিনি সার্জন হতে পারেন, অনকোলজিস্ট হতে পারেন। যেকোনো একজনের কাছে গিয়ে সেটি কিন্তু করা সম্ভব। আমার কাছে ছেলে স্তন ক্যানসারের রোগী রয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছে। মেয়েদের মতোই এর চিকিৎসা।
প্রশ্ন : বলা হয়, ছেলেদের স্তন ক্যানসার নাকি খুব খারাপ পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এটি কি সঠিক?
উত্তর : কোনো কোনো সময় হতে পারে। তবে আমার কাছে যারা এসেছে তিন বছর আগে, ভালো আছে।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার পুনরায় হওয়ার আশঙ্কা থাকে কি?
উত্তর : রোগ সেরে যাওয়ার পর আমরা ফলোআপ করতে বলি। প্রথম বছর দুই মাস, পরের বছর তিন মাস, পরের বছর চার মাস পর পর, এরপর ছয় মাস পর পর করতে বলি। এরপর পাঁচ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত আমরা হরমোনথেরাপি খেতে বলি। সে সময় আমরা রোগীকে তিন থেকে চার মাস পর পর নিয়মিত ফলোআপে আসতে বলি। কারণ, যারা পোস্ট মেনোপোজাল অবস্থায় থাকেন, তাদের অস্টিওপরোটিক পরিবর্তন হতে পারে। হরমোনথেরাপির জন্য কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাদের আমরা আবার প্যাপসমেয়ার করতে বলি। অনেক সময় এডিনোকারসিনোমা পরিবর্তন হতে পারে। চিকিৎসা নিয়ে ফেললাম, আর কাজ শেষ হয়ে গেল সেটি অবশ্যই নয়।