নির্বাচন তুমি কার?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ ছিল তাঁর সরকারের বিভিন্ন অর্জনের বর্ণনা। এ অর্থে এটা সুযোগ ছিল জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে আওয়ামী লীগ সফল শাসক। কিন্তু আট বছর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আগামী দুই বছর পর যা ঘটতে যাচ্ছে। অর্থাৎ নির্বাচন। সেই দিক থেকে এই বক্তব্য ছিল নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম পদক্ষেপ।
নির্বাচনের স্বাস্থ্য কেমন আছে?
রাষ্ট্রপতির অধীনে বর্তমানে চলছে নির্বাচন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন আলাপ ও প্রস্তাব। এর মধ্যে সরকারি দল কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে। যথারীতি সরকারের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ওই সব প্রস্তাবের বিরোধিতাও করেছে। রাষ্ট্রপতির জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া অতটা সোজা হবে না। কারণ, তিনি যে সিদ্ধান্ত নেন না কেন, সেটা নিয়ে আরেক দফা ঝগড়া-ঝাঁটি শুরু হবে।
বাংলাদেশে নির্বাচনটাই একটা কুফা বিষয়। আমাদের রাজনীতির জীবনে খুবই কম সন্তোষজনক নির্বাচন দেখা গেছে। ১৯৯০ সালের আগে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচন নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি না। ২০০৬ সালের পর নির্বাচন নিয়ে যে ঝামেলা শুরু হয় তার বোঝা এখনো টানতে হচ্ছে। তবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন দেখে বোঝা যায়, এতকিছুর পরও সুযোগ পেলে জনগণ অংশগ্রহণ করতে রাজি। ঈর্ষণীয় মানের নির্বাচন করা আমাদের পক্ষেও সম্ভব। কিন্তু তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান রাজনীতিবিদরা নিজেরাই।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অনেক সংখ্যার হিসাব ছিল, যেটা বিশ্লেষক ও গবেষকদের আলাপ-আলোচনার সুযোগ দেবে। কিন্তু তা সাধারণ মানুষের মাথায় তার কতটা গেছে বলা যায় না। কারণ তারা সংখ্যা মনে রাখে না, বক্তব্য শোনে। অর্থনীতি ও রাজনীতির উভয় পরিসরেই মানুষ অংশগ্রহণ করতে চায়। এটা উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এই উন্নয়ন বণ্টনের অন্যতম প্রধান প্রক্রিয়া হচ্ছে নির্বাচন। কিন্তু সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের কেউ বলতে পারবেন না, তাঁরা জনগণের অংশগ্রহণকে নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় মনে করেন। নির্বাচন তাঁদের কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ। এর বেশি কিছু নয়।
আমাদের দেশের নির্বাচন রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এখানে ভোটারদের কাজ হচ্ছে কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানো- এর বেশি কিছু নয়। তাই নির্বাচনের নিম্নমান রাজনৈতিক দলগুলোকে বিচলিত করে না। যেহেতু ক্ষমতায় যাওয়াটাই বিষয়, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়। নির্বাচন কেবল রাজনীতিবিদের হয়ে গেছে, জনগণের নয়।
মানুষ যখন ভোট দেয়, তখন তাঁর মাথায় প্রবৃদ্ধির হার থাকে না। ভোটার একটু উন্নত ও স্বস্তিপূর্ণ আগামী চায়। এটি কেবল সংখ্যাতত্ত্বের ওপর নির্ভর নয়। এটা তার সামাজিক ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ভাবনার ওপর নির্ভরশীল। শেষ নিরিখে জনগণ সুযোগ পেলে প্রমাণ করে কোন সূচকগুলো তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনই এটা প্রমাণের শ্রেষ্ঠ পথ।
মানুষ তাঁর অধিকার রক্ষা বা প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল একটি দলকে রাজনীতিতে চায় না। অনেকগুলো দল চায় যাতে সে নির্বাচন করতে পারে। কোন দলকে সে নির্বাচিত করবে সেটা তার অধিকার। এমনকি দেশের ভোটার একাধিকবার বিএনপির মতো একটি দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। যাদের নির্বাচনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা আছে এই প্রমাণ দুর্বল।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন ও জনগণের ভোট
কোন দল মাঠে থাকবে আর কোন দল থাকবে না, সেটা রাজনৈতিকদের বিবেচ্য বিষয় নয়। যদি না সেই দল বিশ্বাসঘাতক হয়- যেমন জামায়াত। নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত নির্বাচন থেকে দেখা যায় যে সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগের চেয়ে সবল। যার কাছে শামীম ওসমানের মতো আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয় ২০১১ সালে। ওইবার আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৮ ভাগ ভোট, বিএনপি আড়াই ভাগ এবং আইভী পেয়েছিলেন ৬৫ ভাগ। ২০১৬ সালে এসে বিএনপির বাক্সে ভোট পড়েছে ৩৩ ভাগ এবং আইভি পেয়েছেন ৬১ ভাগ। অর্থাৎ ব্যক্তি আইভী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চেয়ে সবল। একই সঙ্গে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে চায় না তেমন ভোটারের সংখ্যাও যথেষ্ট। এটাই বাস্তবতা। এটা নির্বাচনিক গণতন্ত্র।
প্রধানমন্ত্রীর যে বক্তব্যটি সবচেয়ে বেশি মানুষকে উৎসাহিত করেছে, সেটা হচ্ছে তাঁর অঙ্গীকার, আগামীর নির্বাচনগুলো পূর্বের চেয়ে গ্রহণযোগ্য মানের হবে।
বাংলাদেশের নির্বাচন মানসম্পন্ন হয় যখন সরকারি, বিরোধী ও আমলা এই তিন দল সেটা চায়। এই তিন শক্তি না চাইলে নির্বাচন কমিশন এককভাবে কিছুই করতে পারে না। বিরোধী দল নির্বাচনকে কত ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে তার প্রমাণ ২০১৪ সালে বিএনপির ভূমিকা। কেবলমাত্র দলের স্বার্থে নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনের ডাক দিয়ে এই দল জনবিরোধী কাজ করেছে। নির্বাচন বর্জন করার অধিকার তাকে কেউ দেয়নি।
বিরোধী দলের নির্বাচনী অসততা
একাধিক টকশোতে বিএনপির নেতারা আমাকে বলেন, তাঁরা নির্বাচন করতে চান, কিন্তু দলনেত্রী খালেদা জিয়াকে এই কথা বলার সাহস নেই। একই কথা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও খাটে। যেসব দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের এই হাল, তারা জাতীয় গণতন্ত্রের প্রহরী বলে কীভাবে দাবি করে, সেটা বোঝা যায় না।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে বিএনপি ও তার জোট আন্দোলনের ডাক দেয় এবং ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত সব পথ হারিয়ে তারা আবার নৈর্বাচনিক পরিসরে ফিরে আসছে। এটা তাদের নিজেদের স্বার্থেই। তবু যে এসেছে এটা সুখবর। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন আবার প্রমাণ করে যে বিএনপির সমর্থক আছে। তারা ভোট দিতে চায় এবং সেটা প্রয়োগের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপিকে নির্বাচনে থাকতে হবে।
আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাচনকে রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিগত বিষয় বলে ধরে নেওয়া হয়। এটা যে জনগণের সম্পত্তি, তা কোনো রাজনীতিবিদের মাথায় আসে না। যেহেতু ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার সঙ্গে ব্যক্তিগত উন্নতি জড়িত, তাই রাজনৈতিক দুর্নীতিও এত প্রবলভাবে বেড়েছে আমাদের দেশে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করতে পারল না- কীভাবে নির্বাচন করা হবে। তাদের হাতেই এই নির্বাচন প্রক্রিয়া সবচেয়ে দুর্বল বলে প্রমাণিত। আমাদের রাজনীতির ব্যর্থতার সূচকের কোনো প্রবৃদ্ধি কেউ উল্লেখ করেন না। রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন নিয়ে বেশি আলেচনা করাটা রাজনীতিবিদদের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তির।
নির্বাচন জনগণের, রাজনীতিবিদ বা দলের নয়। দলগুলো এটা বিশ্বাস করে না। বোঝা যায়, সে কারণেই শত হিসাবনিকাশের পরও, আলোচনা অনুষ্ঠানের পরও ভোটারের মনে স্বস্তি আসছে না।
লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক