আমাদের সড়কগুলো খুনিই রয়ে গেল
যেদিন তারেক আর মিশুকের মৃত্যুর খবরটা পেয়েছিলাম সেদিন মনে হচ্ছিল বুকের কষ্টটা আমার কোনো দিন যাবে না। ইচ্ছে হচ্ছিল কোনো ওষুধ খেয়ে কষ্টটা কমাই। তারপরের দিন টরেন্টো শহরে যেখানে মিশুক আর আমি এক সঙ্গে বসবাস করেছি বেশ কয়েক বছর, সেখানের এক স্মরণ সভায় যাই। মানুষগুলা কীভাবে কাঁদছিল তা মনে থাকবে। এরা সবাই আমার মতোই তারেক অথবা মিশুকের ঘনিষ্ঠ। একজন কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছিল, আমরা যতজন এখানে আছি তাদের কার জীবন এই দুজনের চেয়ে বড় হবে না, কিন্তু আজ তারা নেই, আমরা বয়স্করা রয়ে গেছি। এই কষ্টটা বেশি বেজেছিল। কারণ, দুজনেই আমার অনেক দিনের ঘনিষ্ঠ, দুজনেই আমার অনেক ছোট। যারা কনিষ্ঠ তারা চলে গেলে কতটা কষ্ট লাগে সেটা যাদের কপালে দুর্ভোগটা হয়েছে তারা বলতে পারবে।
২. তারেককে চিনি সত্তর দশক থেকে। আমরা দুজনেই একই পাড়ার দিলু রোডের বাসিন্দা ছিলাম। এক সময় তারেক আর আমি একই সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, যেটা সত্তর ও আশির দশকে যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। তারেক পরে এসে অডিও ভিজুয়াল কাজ করার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান-অডিও ভিশন- বানায় যার সঙ্গে আমিও কিছু দিন ছিলাম।
সেই সময় তারেকের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো চলছিল না। একদিনকার ঘটনা আমার বড় বেশি মনে পড়ে। আমার তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে, ১৯৭৮ সাল। তারেক আমার কাছে ১০০ টাকা ধার নিল। ওকে টাকাটা ধার হিসেবে না ভেবে ওর প্রয়োজন হয়েছে ভেবেই দিয়েছিলাম। কিন্তু মাস খানেক পড়ে তারেক এসে টাকাটা ফেরত দেয়। আমি যখন টাকাটা ফেরত নিতে অস্বীকার করলাম তখন সে বলল, ‘আপনি বুঝছেন না কেন আমি ফেরত দিচ্ছি যাতে আবার আপনার কাছে ধার নিতে পারি।’
তারেক স্বেচ্ছায় তার এই কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছিল কারণ সে চাইত সৃষ্টিশীল কাজ করতে এবং সব কষ্টই তার জন্য তাই গ্রহণযোগ্য ছিল। মুক্তির গানের আগে পর্যন্ত তারেকের টানাটানি গেছে কিন্তু কোনো দিন তার ইচ্ছে-উদ্দেশ্য থেকে সরেনি, টাকার পথে যায়নি।
৩. মিশুক আমার স্কুলের বন্ধু ভাষণের ছোটভাই। ওকে আমি ছোট বেলা থেকে চিনি তাই কোনো দিনই সে আমার কাছে বাচ্চা ছেলের বাইরে যায়নি। সেই ছেলে বড় হলো, চাকরি করল, বিয়ে করল এমনকি ছেলের বাপ হলো, কিন্তু তবুও ছোট্ট মিশুকই রয়ে গিয়েছিল আমার কাছে।
মিশুক আর আমি এক সঙ্গে বিবিসিতে কাজ করেছি। ও ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করত আর আমি ছিলাম রিপোর্টার। ও তখন অত্যন্ত দায়িত্ববান স্বামীতে পরিণত হয়েছে এবং তার স্ত্রী মঞ্জুলির চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট দৌঁড়াদৌড়ি করত। তার কানাডায় প্রবাসে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এই পারিবারিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা করা। পরবর্তী সময়ে একুশে টিভিতে মিশুক আর আমি আবার সহকর্মী হই। আমি বেশি দিন ছিলাম না কিন্তু মিশুক ছিল ওদের সঙ্গে এবং এই পর্বটা তার জীবনের বড় অর্জনের সময়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রিয় ও যোগ্য ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে আসে যার মধ্যে মুন্নি সাহা একজন।
৪. একটা আশ্চর্য আনন্দের দুপুরের কথা মনে পড়ে আমার মিশুকের টরেন্টোর অ্যাপাটমেন্টে। তারেক আর ক্যাথারিন বেড়াতে এসেছিল শহরে। আমরা সবাই সমবেত হয়ে প্রায় গোটা দিন আড্ডা দিয়েছি পরিবারসহ অতীত আর আগামী নিয়ে। দিনটা অত্যন্ত মধুর ছিল, আজকে সেই স্মৃতি কেবল আনন্দের না কষ্টেরও। কারণ ওইভাবে আর কোনো দিন বসা হবে না। কিন্তু এক সময় মিশুক দেশে ফিরে আসে এটিএননিউজ প্রতিষ্ঠা করতে। আর তারেক তখন হঠাৎ করে বাবা হয়েছে বিয়ের বেশ কিছু দিন যাওয়ার পর। দুজনেই নতুন এক অধ্যায় শুরু করেছে, দুজনে একসঙ্গে কাজও শুরু করেছে। এই রকম একদিন দুজনে গাড়ি চাপা পড়ে এক সঙ্গে চলে গেল। একাত্তর সালের পর এমন করে সহসা মৃত্যুর আঘাত আর পাইনি।
৫. গত সপ্তাহে সেই ঘাতক চালকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হলো। মঞ্জুলি আর ক্যাথরিনের জন্য আশা করি কিছুটা স্বস্তি আসবে কারণ ওইভাবে চলে যাওয়া যে কত কষ্টের সেটা ওরা আর পরিবারের লোকরাই বলতে পারবে। আমি ২০১২ সালে কানাডা থেকে চলে আসি এবং অন্য কয়েকটি কাজের সঙ্গে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক একটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হই। মানুষের কাছে মনে হয় যে একটু সাবধান হলেই এই সড়ক মৃত্যুর হার কমে যাবে কিন্তু আমার ধারণা এটা সম্ভব না। এর কারণ সড়ক কেবল যানবাহন নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য রাজনীতি ও ক্ষমতা প্রয়োগের পরিসর।
অর্থাৎ যা যা দিয়ে ক্ষমতা অর্জিত হয় সবই পাওয়া যাবে এই সড়কের ওপর। অতএব কেউ সড়ক নিরাপদ করবে না কারণ তাহলে দাম চুকাতে হবে রাজনীতি পরিসরের। এক মন্ত্রী আমাকে একটু অসহায় হয়ে বলেছিলেন, ‘রাস্তার পাশে যেসব হাট-বাজার থাকে সেসব যে যানবাহনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এটা তো বোঝাই যায় কিন্তু কী করব বলেন? এসব তো আমাদের দলের কর্মীদের আয়ের ব্যবস্থা করে আর কর্মী ছাড়া দল টিকবে না আর দল ছাড়া দেশ টিকবে না অতএব......’
অতএব ক্ষমা করে দিও তারেক ও মিশুক। আমাদের সড়কগুলো খুনিই রয়ে গেল।
লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক