পাখিদের নিয়ে ভাবনা
থাই গ্লাস; পাখিদের মৃত্যুর জানালা!
রেনে দেকার্ত ১৭ শতকের একজন অন্যতম পশ্চিমা দার্শনিক ছিলেন, যাঁর দর্শন দ্বারা পরবর্তীকালে প্রভাবিত হয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত সব দার্শনিক যেমন লেবনিজ, হিউম, লক এবং কান্টের মতো দার্শনিকরা। দেকার্ত তাঁর ‘ডিসকোর্স অন মেথড অ্যান্ড দ্য মেডিটেশন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে মানুষের চিন্তাশক্তি আছে যার দ্বারা মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘কোজিটো ইরগো সাম (cogito Ergo Sum)। খুব সম্ভবত পাখ-পাখালির এমন শক্তি নেই, তাই তারা আয়নায় তাদের নিজেদেরকে চিনতে পারে না।
আমার ভাড়া বাসাটি তিনতলাবিশিষ্ট। ছাদের ওপর চিলেকোঠার মতো একটা ঘরে আমি থাকি যার উত্তর এবং দক্ষিণের জানালায় থাই গ্লাস লাগানো আছে। প্রায় প্রতিদিন সকালে ‘ধপাস-ধাম’ শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। জানালার থাই গ্লাসটা যখন বন্ধ থাকে, তখন উড়ন্ত পাখিরা প্রায় ভুল করে আছড়ে পরে থাই গ্লাসের জানালার ওপর।
জানালাগুলো বন্ধ থাকে বিশেষ করে সকালে এবং আমি যখন কাজের জন্য বাইরে যাই তখন। বন্ধ জানালাগুলো পাখিদের সামনে এক বিশাল আয়নার মতো কাজ করে। এই আয়নায় পাখিরা দেখতে পায় খোলা নীল আকাশ, বিপরীত পাশের সব গাছপালা, বাড়িঘর, অন্য বাড়ির ছাদ, ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশ বা রডের খুঁটি। এসব দেখে পাখিরা উড়ে যেতে চায় সেখানে, আর এভাবেই পাখিরা আছড়ে পড়ে আমাদের থাই গ্লাসের জানালায়।
পাখিরা যখন আঁছড়ে পড়ে, থাই গ্লাসে তখন অনেক জোরে আঘাত লাগে তাদের মাথায়, বিশেষ করে বুকে ও পাজরে। পাখিরা আকারে ছোট হলেও তাদের ভর-বেগ নেহাত কম নয়। অনেক পাখি আঘাত লাগার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যায়। আবার কোনো কোনো পাখি দুর্ঘটনার পরে কিছু সময়ের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বেশ কয়েকবার আঘাতপ্রাপ্ত পাখির গায়ে-মাথায় পানি ঢেলে সুস্থ করা গেছে, কিন্তু বাকি পাখিগুলো মারা গেছে। যেসব পাখিরা এই ঘটনায় মারা যায় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; চড়ুই, শালিক, গুদুরকানি, ঘুঘু, বুলবুলি, কাক, দোয়েল ইত্যাদি। এদের মধ্যে অনেক প্রজাতির পাখিই আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। মৃত পাখির পালক এখনো লেগে আছে জানালার থাই কাচের গায়ে|
এমন করুণ অভিজ্ঞতা যে শুধু আমারই হচ্ছে এমন নয়, আমার মনে হয় এই একই অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে। আজকাল গ্রাম থেকে গঞ্জে, শহর থেকে মহাশহরের অলিতে-গলিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। সবখানেই এখন দেখা যায় বহুতলীয় ভবন, যার বেশির ভাগ বাড়িতেই ব্যবহার করা হচ্ছে থাই কাচের জানালা।
থাই কাচের জানালা পাখিদের কাছে এতটাই মরীচিকার মতো যে কাকের মতো চালাক পাখিও তা বুঝতে পারে না। আপনি একটা কাকের গায়ে শতবার চেষ্টা করেও ঢিল লাগাতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে অথচ কাক নিজে এসেও আছড়ে পরে থাই কাচের জানালায়।
ছোটবেলায় যখন গ্রামে থাকতাম, সকালবেলা ঘুম ভাঙত বাঁশঝাড়ে বসতি গড়া পাখিদের কলরবে আর এখন এই আধুনিক শহুরে জীবনে ঘুম ভাঙে পাখিদের মৃত্যুর শব্দে। সমস্যা হলো পাখিরা মানুষের মতো আর্তনাদ করতে পারে না, বিলাপ করতে পারে না, রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে পারে না, গাড়ি ভাঙচুর করতে পারে না কিংবা হরতাল ডেকে মানুষের জীবন অচল করে দিতে পারে না, তাই হয়তো পাখিদের মৃত্যু আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।
শুধু বন-বাদাড়; পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস, নগরায়ন-শহরায়ন, শিল্পায়ন, কৃষিতে অধিক কীটনাশকের ব্যবহার, ক্ষতিকর মেডিকেল বর্জ্যের আধিক্যই পাখিদের মৃত্যুর কতিপয় কারণ নয়, মানবসৃষ্ট আরো অনেক কারণ রয়েছে, যা আজও আমাদের অজানা।
মানুষের সভ্যতা এখন অনেক বেশি ছলনাময়ী হয়ে উঠেছে। মানুষ শুধু এখন প্রত্যক্ষভাবে মানুষকেই ধোঁকা দিচ্ছে না, ধোঁকা দিচ্ছে নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা এবং পশু-পাখিকে। পরিবেশের যে জটিল আন্তঃজাল রয়েছে, সেখানে আমরা প্রতিটি জীব একে-অপরের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। মোট কথা হলো, মানুষের গড়া অপরিকল্পিত এবং প্রকৃতি বিরুদ্ধ উন্নয়ন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতি করছে প্রকৃতি এবং পরিবেশের আর প্রকৃতি যত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পৃথিবী থেকে মানবসভ্যতা তত দ্রুতই বিদায় নেবে। হালের দিগ্বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস প্রায়ই ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন যে পৃথিবী আর বড়জোর ১০০ বছর এই চলমান মানবসভ্যতাকে ধারণ করতে পারবে, তার মধ্যেই মানুষকে বসতি গড়ে তুলতে হবে পৃথিবী সাদৃশ্য অন্য কোনো গ্রহে, নাহলে মানুষ নামের বুদ্ধিমান প্রাণীরা চিরতরে বিদায় নেবে এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে|
কার্ল মার্কস মনে করতেন, মানুষের শ্রম এবং তার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই হলো সমাজের মূল ভিত্তি, মৌলিক কাঠামো। কিন্তু যদি কার্ল মার্কস-এর কথা সত্য হয়ে থাকে তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই পৃথিবীর ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশই হলো মানবসভ্যতার মূল কাঠামো যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের টিকে থাকার আশা-ভরসা। প্রকৃতি ধ্বংস তো আমরাও ধ্বংস। পাখিদের কোজিটো নেই, কিন্তু আমাদের তো আছে, আমাদের কোজিটো দিয়েই না হয় বন্ধ হোক পাখিদের এই করুণ মৃত্যু। এসব থাই গ্লাস তৈরি করতে যেমন অধিক পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তেমনি আবার এর ব্যবহারে প্রত্যক্ষভাবে মরছে বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের জাত। আমরা মানুষ, আমাদের হাতে আছে বিকল্প কৌশল। পরিবেশে এবং প্রকৃতিকে বাঁচাতে আমাদের বিকল্পটাই ভাবতে হবে। শুধু আধুনিকতাই নয়, সুস্থ পরিবেশে টিকে থাকাটাও মানুষের কাম্য হওয়া উচিত।
লেখক : স্নাতকোত্তর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সাউথ এশিয়ান উনিভার্সিটি (সার্ক বিশ্ববিদ্যালয়), নয়াদিল্লি, ভারত)