মুক্তামণির জন্য শুভকামনা
মাস দুয়েক আগের কথা। কেবিনের বিছানায়, আক্রান্ত ডান হাত আর ডান পায়ের পুরোটাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে ছিল মুক্তামণি। পাশে যমজ বোন ছোট ভাইকে নিয়ে মোবাইলে গেমস খেলছিল। সেটাই ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার দেখছিল সে। আর বলছিল, ‘আমি যে কবে একেবারে ভালো হয়ে যাব। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে চাই। চাই আবার স্কুলে যেতে, আর তখন সবাইকে আমার হাত দেখাব, ছোট ভাইকে কোলে নেব।’
বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মুক্তামণি প্রায় ছয় মাস পর গত শুক্রবার বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি সে। তার ছোট ভাইকে হাতে করে কোলে তুলে নেওয়ার মতো অবস্থায় এখনো আসেনি মুক্তামণি। মুক্তামণি ও তার পরিবারের সদস্যরা অনেক দিন থেকে বাড়িতে যেতে চাইছে বলে তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এখনো তাকে ফলোআপে রেখেছেন চিকিৎসকরা। মুক্তামণিকে আবার হাসপাতালে যেতে হবে। তবে হেমানজিওমা রোগে আক্রান্ত মুক্তামণির আর অস্ত্রোপচার করার দরকার নেই।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কামারবায়সা গ্রামের মুদি দোকানি ইব্রাহীম হোসেনের মেয়ে মুক্তা। ইব্রাহীমের দুই যমজ মেয়ে ও এক ছেলে। যমজ মেয়ের মধ্যে হীরা বড় ও মুক্তা ছোট। জন্মের পরে দেড় বছর ভালোই ছিল মুক্তা। এরপর তার ডান হাতে ছোট মার্বেলের মতো গোটা দেখা দেয়। ক্রমেই তা বাড়তে থাকে। মুক্তার হাতটি দেখলে মনে হতো, গাছের বাকলের মতো ছেয়ে গেছে। আক্রান্ত হাতটি তার দেহের সব অঙ্গের চেয়েও ভারী হয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় মুক্তা সব সময় অস্থির হয়ে থাকত। তার সারা দেহে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। শরীর শুকিয়ে যায়। শুধু হাতের ওজন বাড়তে থাকে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে দেখানো হয় মুক্তাকে। কিন্তু কেউ সঠিক চিকিৎসা দিতে পারেনি। টাকার অভাবে ছয় মাস চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মুক্তাকে বাড়িতে রেখে কেবল ড্রেসিং করা হয়।
এরপর চলতি বছরের ১১ জুলাই মুক্তাকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে বার্ন ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে আট সদস্যের টিম মুক্তামণির চিকিৎসা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে শুধু রোগ নির্ণয় করতে সফল হন তাঁরা। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানতে পারেন, মুক্তামণির হাতের রক্তনালিতে টিউমার রয়েছে, যা বাংলাদেশের অন্যান্য হাসপাতালের চিকিৎসকরা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন।
এই রোগের চিকিৎসার জন্য গত ২৭ জুলাই সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এক ই-মেইলের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল জানায়, মুক্তামণির এই রোগটি ভালো হওয়ার নয়। অপারেশনের মতোও নয়। তবে তারা রোগটির পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করার কথা জানায়।
তাদের এই কথার অর্থ দাঁড়ায়, মুক্তামণির হাত কখনো ভালো হবে না। তাই সংবাদমাধ্যমগুলোয় মুক্তামণির হাত কেটে ফেলা হতে পারে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়। তবে হাল ছাড়েননি ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশক্রমে নিজেরাই এই রোগের অপারেশনের পদক্ষেপ নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ২ আগস্ট বুধবার। ১৩ জন চিকিৎসককে নিয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ৩ আগস্ট মুক্তামণির শরীর থেকে বায়োপসি নেওয়া হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় মুক্তামণির রক্তনালিতে টিউমার হয়েছে, তার রোগটি মোটেও বিরল নয়।
এরপর ১২ আগস্ট সকালে শুরু হয় মুক্তামণির হাতের অপারেশন। মুক্তামণির ডান হাত থেকে প্রায় তিন কেজি ওজনের টিউমার অপসারণ করেন চিকিৎসকরা। চলতে থাকে মুক্তার চিকিৎসা। গত ১০ অক্টোবর মুক্তামণির হাতে প্রথম চামড়া লাগানো (স্কিন গ্রাফটিং) হয়। এর পরের দিনই তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া চলতি মাসে স্কিন গ্রাফটিংয়ে মুক্তার হাতে ৫০ শতাংশ চামড়া লাগানো হয়েছে। এই স্কিন গ্রাফটিং হলো মুক্তার সুস্থ হওয়ার প্রথম ধাপ। কয়েক দিন পর হাতের বাকি অংশতেও চামড়া লাগানোর হবে। তবে সেটা বেশ কয়েক দিন পর।
মুক্তামণি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক। পূরণ হোক তার স্বপ্নগুলো। প্রত্যাশা রাখি, এবার যখন সে হসপিটালে যাবে, সেখান থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে দ্রুত বাড়িতে ফিরে তার ছোট ভাইকে যেন কোলে তুলে নিতে পারে। সে যেন সমাজের অন্য সব মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারে। শুভকামনা রইল মুক্তামণির জন্য।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।