অভিমত
চাপে সংকুচিত বাংলাদেশের সাংবাদিকতা
‘সাংবাদিকতা’ ও ‘ঝুঁকি’ শব্দ দুটি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো। মুক্ত সাংবাদিকতা যেখানে চাপের মুখে থাকে, সেখানে ঝুঁকিটা বেশ আতঙ্কজনক। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভয়ভীতি এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক চাপ স্বাধীন সাংবাদিকতার বড় বাধা। তার ওপর ৫৭ ধারার মতো রাষ্ট্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যথেচ্ছাচার ব্যবহার বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সাংবাদিকরাও এখন গা বাঁচিয়ে চলেন, অপরাধ অনুসন্ধানে তাঁদের আর আগ্রহ নেই। কার্যত এখানকার গণমাধ্যমকে এক ধরনের আতঙ্কের মধ্য দিয়ে সীমিত তথ্যের রোজনামচা পরিবেশন করে যেতে হচ্ছে।
এতে পাঠক যেমন আসল সত্য জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, পাশাপাশি হেভিওয়েট সমাজবিরোধীরাও নির্বিঘ্নে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে পারছে। রাজধানী বা মফস্বল পুরো দেশজুড়েই সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে সাংবাদিক ও সম্পাদক-নির্বিশেষে প্রভাবশালীদের নির্যাতন বা মামলার মুখে পড়তে হচ্ছে। বলা যায়, অদৃশ্য প্রেশার থেকে মুক্তি পেতে সংবাদমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপের সবিশেষ উদাহরণ গেল ২০১৭ সাল।
অভিযোগ রয়েছে, সরকার নিজেদের বিরুদ্ধে বিতর্ক ও সমালোচনা ঠেকাতে সংবাদমাধ্যমের ওপর দমনপীড়ন চালায়। এ ক্ষেত্রে তাদের সহায়ক হিসেবে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইন। যে আইনে ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। আবার সরকারি ছত্রছায়ায় বেসরকারি পর্যায়ের প্রভাবশালী গোষ্ঠীও একই কাজ করে। সে ক্ষেত্রে সরকারি এজেন্সিগুলোও ৫৭ ধারা নিয়ে সেইসব প্রভাবশালীর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এভাবে চাপে পড়ে অনেক মিডিয়া হাউস যেমন নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে, তেমনি যাচ্ছেতাইভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কথা মাথায় রেখে গড়ে তোলা হচ্ছে টেলিভিশন স্টেশন ও পত্রিকা। যদিও অনেক টেলিভিশন স্টেশন ও পত্রিকা তাদের সংবাদকর্মী ও স্টাফদের বেতন পরিশোধ করার সক্ষমতা রাখে না। একদিকে দমনপীড়ন, অন্যদিকে নিজেদের রুটি-রুজি নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে সমাজে প্রভাববিস্তার করতে পারে—এমন সাংবাদিকতা আজকাল খুব কমই দেখা যায়।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৭ সালে সারা বিশ্বে অস্বাভাবিকভাবে নিহত হয়েছেন ৬৫ জন গণমাধ্যমকর্মী। তাঁদের মধ্যে ৫০ জন পেশাদার প্রতিবেদক। নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে ৩৯ জন খুন হয়েছেন। অন্যরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নিহত হন। গেল বছরের ফেব্রুয়ারিতে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেখানকার পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরুর ব্যক্তিগত শটগানের গুলিতে প্রাণ হারান দৈনিক সমকালের স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল। এর বাইরে বাংলাদেশকে অবশ্য গেল বছর অন্য কোনো খুনের ঘটনার সাক্ষী হতে হয়নি। তবে সাংবাদিকদের অবাধ চলন থামিয়ে রাখতে এর আগের কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, যাদের বিচারকাজ যথাবৎ সম্পন্ন করা যায়নি। এর মধ্যে সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির খুনের ঘটনা সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) কর্তৃক গেল নভেম্বরে প্রকাশিত ‘গেটিং অ্যাওয়ে উইথ মার্ডার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংবাদিক হত্যায় বিচার না হওয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দশম, যা এর আগের বছরের অনুরূপ। অর্থাৎ সাংবাদিক হত্যার বিচারহীনতার দিক থেকে আমরা বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়ই।
গেল বছর মে মাসে প্রকাশিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর বাংলাদেশ সরকার বিতর্ক ও সমালোচনা ঠেকাতে দমনপীড়ন চালিয়েছে। মিডিয়াকর্মীদের হয়রানি ও কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের পাশাপাশি দমনমূলক আইনের আওতায় তাঁদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে।
অন্যদিকে পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসেই ১৯ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন স্থানীয় মন্ত্রী-সাংসদদের ঘনিষ্ঠজন। বাকি ছয় মাসেও বেশ কয়েকটি এমন হয়রানিমূলক মামলার নজির রয়েছে। ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের নজির স্থাপনকারী বর্ষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে ২০১৭ সাল। সরকারের তরফে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা খর্ব করতে ৫৭ ধারা এখন মোক্ষম উপায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার প্রকৃত পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাও তাদের উদ্বেগ চেপে রাখেনি।
আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স রিপোর্ট অনুযায়ী, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ভোগের দিক থেকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬। অর্থাৎ ১৪৫টি দেশ আমাদের ওপরে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের অবস্থান সবচেয়ে নিচে : ভুটান ৮৪, নেপাল ১০০, ভারত ১৩৬ ও পাকিস্তান ১৩৯ নম্বরে আছে। শুধু তা-ই নয়, গত এক বছরে আমরা আরো দুই ধাপ নেমে গেছি। ২০১৬ সালে আমাদের অবস্থান ছিল ১৪৪। ইনডেক্সের এমন অবনমনের অন্যতম কারণ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান গ্রহণ।
বেসরকারি পর্যায়ে আইসিটি আইনের অপব্যবহার হিসেবে ঢাকার একটি অনলাইন পোর্টাল ‘নতুন সময় ডটকম’-এর নির্বাহী সম্পাদক আহমেদ রাজুর কথা বলা যায়। যাঁর বিরুদ্ধে নিজেদের পণ্য নিয়ে অসত্য খবর পরিবেশনের অভিযোগ এনে চাঁদাবাজি ও আইসিটি আইনে মামলা করে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। দুই মামলায় ওই সম্পাদককে রিমান্ডও দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, বছরের শুরুর দিকে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় একুশে টেলিভিশনের সাভারের স্থানীয় সাংবাদিক নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে মামলা করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। এ মামলায় নাজমুলকে দুই মাস কারাগারেও কাটাতে হয়। টেলিভিশন, পত্রিকা বা অনলাইনভিত্তিক সাংবাদিকতা বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের রোষানালে পড়ছে, এটা কঠিন বাস্তবতা। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখিরা কারণেও আইসিটি মামলার শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। সাংবাদিক প্রবীর শিকদার এর অনন্য উদাহরণ।
রাজধানী কিংবা দেশের অপরাপর জেলায় সমান্তরালভাবে সব সাংবাদিককেই কালো আইন ৫৭ ধারার বেড়াজালে পড়ে নাজেহাল হতে হচ্ছে। আঞ্চলিক সাংবাদিকদের দুঃখ আরেক জায়গায়। ঢাকার মিডিয়া হাউসের অধিকাংশই চারণ সাংবাদিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান করে না। বিশেষ করে নতুন আসা কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরা উল্টো লোকাল সাংবাদিকদের পকেট কাটার মানসিকতা পোষণ করেন। কারণ, চ্যানেল মালিক তাঁদের বেতনও সময়মতো পরিশোধ করেন না। নতুন আসা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মফস্বলের কেবল লাইনে চালাতে গেলে নগদ অর্থ বা বস্তুগত বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে কেবল অপারেটরদের ম্যানেজ করতে হয়। সেই ম্যানেজ করার দায়দায়িত্বও চাপিয়ে দেওয়া হয় নিজেদের হাউসের মফস্বল সাংবাদিকদের। খুব স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিককে হন্যে খুঁজতে হওয়া টু-পাইস কামানোর ধান্ধা। যে সাংবাদিক নিজের জীবন-জীবিকা ঠিক রাখতে এবং চাকরি বাঁচাতে অন্যায্য পথে টাকা উপার্জনের পেছনে দৌড়াবেন, তিনি দেশ ও দশের জন্য কার্যকরী সৎ সাংবাদিকতা কখন করবেন, কীভাবে করবেন?
ইদানীং সাংবাদিকদের মধ্যে অপহৃত হওয়ার আতঙ্ক ভর করছে। কোনো এক গোপন গোষ্ঠী তুলে নিয়ে যাচ্ছে, দু-এক মাস গোপন জায়গায় অন্তরীণ রেখে ছেড়েও যাচ্ছে। এই রহস্যজনক অপহরণের কোনো কূলকিনারা করছে না সরকার। এমন ঘটনার সর্বশেষ উদাহরণ নরসিংদীর সাংবাদিক উৎপল দাস। সাংবাদিকদের মধ্যেও যদি খুন, গুম বা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার ভয় ঢুকে যায়, তবে তথ্যানুসন্ধান কিংবা সত্য প্রকাশ যেমন আর হবে না, তেমনি সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের ‘ওয়াচডগ’ও হয়ে ওঠা আর হবে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা ক্ষমতাসীন মানুষ অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে নিশ্চিতই সঠিক পথের দিশা হারিয়ে ফেলতে পারে।
মধ্য ডিসেম্বরে ঢাকায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান লক্ষ্য দারিদ্র্য বিমোচন। আর দুর্নীতি থাকলে দারিদ্র্য বিমোচন হবে না। তাই সরকার জোরালো, সাহসী ও সৎ সাংবাদিকতা চায়।‘ এই চাওয়াটা সন্দেহাতীতভাবে উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু বাস্তবতা নিশ্চিতই কারুণ্যে ভরা।
সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, তাঁরা আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বাতিল করতে চান। কিন্তু বাতিল করে নতুন যে ধারা অথবা পূর্ণাঙ্গ আইন প্রস্তুত করা হবে, তা ৫৭ ধারার বিষময়তা ছাড়িয়ে যাবে না, তা আগাম কে বলতে পারে?
যেদিন কালের গর্ভে অন্তর্হিত হয়ে গেছে, সেই দিনগুলোর বেদনাময় দিক আমরা ভুলে থাকতে চাই। মনে রাখতে চাই ভালো ও সুন্দরের সবটুকু। আমরা চাই, সাংবাদিকরা আড়ষ্টতা, দ্বিধা, ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে স্বাধীনভাবে তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করার ফুরসতটুকু পাবেন। মন খুলে সত্যটা লিখতে পারবেন, প্রকাশ করতে পারবেন। নিজেদের প্রাগ্রসরতাকে ধরে রাখতে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের যথার্থ কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে দেবেন, এমন কেউ কি কোথাও আছেন?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।