২০১৮
রাজনীতির ময়দানে নির্বাচনের হাওয়া
পুরাতনের সব ব্যর্থতা, দুঃখ-কষ্ট এবং হতাশা পেছনে ফেলে চিরাচরিতভাবে আরেকটি বছরকে বরণ করে নেওয়া হলো। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-শান্তি ও উন্নতির পাশাপাশি নতুন বছরে সবারই কামনা, দেশে যেন শান্তি বজায় থাকে। তবে প্রশ্ন, ২০১৮ সালটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক হবে! যাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস করেন, তাঁদের নিশ্চয় কৌতূহল সারা বছরের গ্রহাবস্থান বিশ্লেষণ করে জ্যোতিষরা বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বলছেন?
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কি দেশের মানুষের মধ্যে কোনো শঙ্কা কাজ করছে? গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। ভোটাররা নিজের পছন্দের দল বা প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন, এমন নিশ্চয়তা।
২০১৮ সালটি কি নির্বাচনী বছর? নাকি আবারও হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ ধরলে এ বছরের শেষ দিকে অথবা আগামী বছরের প্রথমে নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে একদল বলছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। আরেক দলের দাবি, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন—তা নিয়ে দুই বড় দল বিপরীত মেরুতে থাকলেও রাজনৈতিক তৎপরতা যেভাবে বেড়েছে, তাতে বলা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখন নির্বাচনমুখী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন জেলা সফরে নৌকায় ভোট চাইছেন। এমপি-মন্ত্রীদের নির্দেশ নিয়েছেন, নিজ নিজ এলাকায় বেশি সময় দিতে। সারা দেশে সম্ভাব্য প্রার্থীদের গোয়েন্দা রিপোর্টও সংগ্রহ চলছে।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন আবারও হয়তো দুই দল ঘটা করে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ ও ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালন করবে। এ বছর ১২ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের চার বছর পূর্তি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, এদিন থেকেই জেলা পর্যায়ে নির্বাচনী সফরে বের হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী প্রস্তুতির পাশাপাশি এ সফরের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলার রায়-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি মামলার বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে। এর একটিতে তারেক রহমানও আসামি। আওয়ামী লীগের নেতারা হয়তো মনে করছেন, এ দুই মামলায় খালেদা জিয়া ও তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানের সাজা হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপকভাবে প্রচারের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামছে ক্ষমতাসীন দল। এ সময় খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা অর্থ সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আনার বিষয়টিও প্রচারে আনা হবে।
এ ছাড়া দুই মেয়াদে গত নয় বছরে শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ এবং ২০১৪-১৫ সালে বিএনপি হরতাল-অবরোধের সময় জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা প্রচার করা হবে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, রাজপথে আন্দোলন ছাড়া সামনে কোনো উপায় দেখছে না বিএনপি। দলটির একটি অংশ মনে করছে, পরিস্থিতি যাই হোক, আগামী জাতীয় নির্বাচনেও অংশ না নিলে দল বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে বিএনপি।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তি, খালেদা জিয়ার মামলার রায়, ছয় সিটি করপোরেশন নির্বাচন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি—এ বিষয়গুলো সামনে রেখে বছরজুড়ে মাঠে থাকতে চায় বিএনপি। খালেদা জিয়াও দলের নেতাকর্মীদের আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এরই মধ্যে আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দলের ৭৭টি সাংগঠনিক জেলায় সফর শুরু করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা।
বলা যায়, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও খেলা চলবে সংসদে প্রধান বিরোধী দল আর সরকারের অংশ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে। জোট-মহাজোটের খেলায় অবশ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এই দলটি। সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক এবং সন্ধ্যায় অন্য কথা বলে রাজনীতিতে আনপ্রেডিকটেবল হিসেবে পরিচিত পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। যিনি সব সময় জেল খাটার ভয়ে ভীত থাকেন। ফলে সব সময়ই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেরই টার্গেটে থাকেন তিনি ও তাঁর দল।
এরশাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য, আপাতত আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে আছে জাতীয় পার্টি। তবে আগামী দিনে কী হবে, কীভাবে নির্বাচন হবে—সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য তাঁর। তবে বেশ আগে থেকেই বলে আসছেন আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার কথা।
বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্পধারা, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে গঠিত ‘যুক্তফ্রন্ট’ নতুন জোটকে সব দল স্বাগত জানালেও রাজনীতির মাঠে তাদের প্রভাব বিস্তার এখনো অনেক দূরের হিসাব-নিকাশ।
সময় সময় প্রতিবাদে মুখর থাকে বাম দলগুলো। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করলেও নিজেদের নেতৃত্বে দ্বন্দ্বে ভেঙে টুকরো টুকরো দলে পরিণত হচ্ছে। কেউ কেউ আগেই বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের শরিক। ফলে আগামী নির্বাচনেও আলাদাভাবে প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা কম।
অবশ্য জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য রাজনীতি না থাকলেও ২০ দলীয় জোটে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আন্দোলন-সংগ্রামের দরকষাকষির কথা শোনা যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বয়স্ক নেতাদের বেশ কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে। তবে নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় আছে দলটি। যদিও এখনো ঠিক নেই, জামায়াতের নেতারা নিজ দলের হয়ে আদৌ নির্বাচন করতে পারবেন কি না। তারপরও বিএনপির সঙ্গে আগেভাগেই একটা ফয়সালা করে রাখতে মরিয়া দলটি। এ ক্ষেত্রে একাদশ নির্বাচনকে ঘিরে জামায়াতের মাস্টারপ্ল্যান শোনা যাচ্ছে—তারা নাকি অন্তত ৫০ থেকে ৬০ আসন দাবি করবে। দলীয় প্রতীক না পেলে ধানের শীষ অথবা স্বতন্ত্রভাবে লড়তে চায় এই বিতর্কিত দলটি।
বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য, রাজনীতিবিদরা অতীত থেকে শিক্ষা নেন না। এরশাদের স্বৈরশাসনের কথা বাদ দিলেও নিকট অতীত ওয়ান-ইলেভেন বা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের কথা বলা যায়। রাজনীতিবিদদের গণহারে অপরাধী সাব্যস্ত করে জেলে পাঠানো হয়। আটক থাকলেন দুই নেত্রী। তবে রাজনীতিবিদদের কেউই ওই ঘটনাকে রাজনৈতিক শুদ্ধাচার হিসেবে গ্রহণ করেননি।
বাংলাদেশের নির্বাচনের একটি মন্দ দিক বিদেশ-নির্ভরতা। কোনো সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আবার কোনো সময় প্রতিবেশী ভারতের প্রভাব। তখনকার ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেস পাশে থাকায় আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে নিতে পেরেছিল, এ কথা সবারই জানা। আসছে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি বেশ আগে থেকেই বিদেশিদের কাছে গুম, খুন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড না করতে দেওয়ার ব্যাপারে নালিশ করে আসছে। বসে নেই আওয়ামী লীগও। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক তৎপরতায় ব্যর্থ হলেও আগামী নির্বাচনে ভারত, চীন ও রাশিয়াকে পাশে রাখতে চায় দলটি। তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপিকে কি আওয়ামী লীগ আস্থায় রাখতে পারবে, সেই প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। যদিও বিএনপির দাবি, এবার আর ভারতের একতরফা সমর্থন পাবে না আওয়ামী লীগ।
২০১৪ নির্বাচনের আগেও একবার বেশ কথাকাটাকাটি হয়েছিল। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সংবিধান অনুয়ায়ী নির্বাচন হবে, সেখান থেকে একচুলও নড়া হবে না। পাল্টা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন : ‘আন্দোলনের বাতাস শুরু হলে চুল তো থাকবেই না, অস্তিত্বেও টান পড়তে পারে। জনগণের আন্দোলনের বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে যাবে। দিশেহারা হয়ে যাবেন।’
নতুন বছরটি রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে যাওয়ার যেমন আশঙ্কা থাকছে, তেমনটি রোহিঙ্গা সমস্যার যে আশু সমাধান নেই, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। ফলে বর্তমান সরকারকে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ সামলানোর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। রোহিঙ্গাদের কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপও মোকাবিলা করতে হবে।
কয়েক মাস ধরে বিএনপি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়ার কথা বললেও এখনো প্রস্তাব তুলে ধরেননি খালেদা জিয়া। অবশ্য সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ মনে করে, এখনো অনেক সময় আছে। এখনই তা উত্থাপন করলে আর তা আওয়ামী লীগ যদি নাকচ করে দেয়, সে ক্ষেত্রে বিএনপির হাতে আর কোনো অস্ত্রই রইল না। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যপারে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনড় থাকলেও বিভিন্ন সময়ে নানা প্রস্তাবও আলোচনায় আছে। এ ব্যপারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দুদলের জন্য একটি মাঝামাঝি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। তিনি চান, নির্বাচনকালে শেখ হাসিনাই প্রধান থাকলেন। তবে তাঁর ক্ষমতা সীমিত করে দেওয়া হলো। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল থেকে সংক্ষিপ্ত মন্ত্রিসভার সদস্য থাকল।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে. এম. নুরুল হুদা পক্ষপাতদুষ্ট এবং তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয় বলে কমিশনকে চাপে রাখতে চায় বিএনপি। তবে কমিশনের সঙ্গে বিএনপির সংলাপে জিয়াউর রহমান প্রশংসাকেও সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। তবে এই কমিশনের অধীন কুমিল্লা ও রংপুরে দুই সিটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যদিও তিনটি নির্বাচনেই অনিয়মের অভিযোগ ছিল বিএনপির। এর মধ্য নিয়ে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের বদনাম ঘোচানোর এবং নিজেদের আস্থায় আসার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ রংপুর সিটি নির্বাচন একটি মডেল নির্বাচন বলা যায়। তবে জাতীয় নির্বাচনের সময় কমিশনের ভূমিকা কেমন থাকবে, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ আছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হতে পারে। এর পরবর্তী পরিস্থিতি কী হয়, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। এ সময় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের তরফ থেকে দল ও জোট ভাঙার চেষ্টা হতে পারে।
আগামী একটি বছর রাজনীতির মাঠে অনেক জল ঘোলা হবে। তর্ক-বিতর্ক হবে, তবে আর যেন গুম-খুন-রক্তের খেলা না চলে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা থাকার জন্য। দেশের মানুষ চায়, বিএনপি প্রধান যে ক্ষমা ও ইতিবাচক রাজনীতির কথা বলেছেন, তা যেন শুধু রাজনৈতিক বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ হয়ে না যায়। আর আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে এবং বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন। তাঁর ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে আগামী নির্বাচন এবং রাজনীতির ভবিষ্যৎ। দেশের মানুষ আশা করতেই পারেন, আরেকটা ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হবে না।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।