অভিমত
শিক্ষকদের আহাজারি আর কতদিন?
তারা শিক্ষক। তারা মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের হাতেই প্রথম আঁকাবাঁকা হাতের লেখা প্রথম অক্ষর। তারাই ছোটবেলায় সুর ধরে পড়িয়েছেন ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।’ লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়েছেন, শিক্ষিত করেছেন, গড়ে দিয়েছেন সুন্দর ভবিষ্যত। তাদেরই দেখানো পথে, তাদেরই শেখানো বুলিতে লেখাপড়া করে ছাত্র-ছাত্রীরা গাড়ি ঘোড়া চড়লেও, অন্ধকারে থেকে গেছেন তারা। তাদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেনি। গাড়ি ঘোড়া দূরে থাকুক, ঘোড়ার চাবুক কেনার সামর্থও তাদের জোটেনি। অনহারে অর্ধাহারে কেটে যায় দিন। অসুস্থ হলে ওষুধ কেনার সামর্থটুকুও থাকে না তাদের। নেই কোনো মাসিক বেতনের নিশ্চয়তা সরকারের তরফ থেকে। একেবারে পেটে ভাতের কামলা বলতে যা বোঝায়, নন-এমপিওভুক্ত স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকরা যেন ঠিক তাই। তাদের আহাজারি দেখার কেউ নেই। অথচ দেশব্যাপি ছড়িয়ে থাকা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার অনুমোদন প্রাপ্ত নন-এমপিও স্কুল-মাদ্রাসার প্রায় ৮০-৯০ হাজার শিক্ষক স্কুল কমিটির নামমাত্র সম্মানীর ওপর ভর করে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি বা এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকদের চেয়ে দেশের শিক্ষাখাতে যাদের অবদান মোটেই কম নয়। বছরের পর বছর থেকে তারা বিনাবেতনের এই চাকরী করছেন এই আশায় যে, একদিন তাদের ওপর নজর পড়বে সরকারের। তাদের জন্যও মাসিক ভিত্তিতে বেতন বরাদ্দ দেওয়া হবে। ধৈর্য ধরতে ধরতে আর না পেরে নিতান্ত বাধ্য হয়ে তারা আন্দোলনে নেমেছেন। টানা সপ্তাহখানেক আন্দোলনের পরও যখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল নাম, তারা বাধ্য হয়েই আন্দোলনের শেষ অস্ত্র হিসেবে আমরণ অনসনে বসেছেন। তাও আজ তিন দিন পার হয়ে গেল।
এই প্রচন্ড শীতের রাতে প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায়, ফুটপাতে জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন আমাদের মানুষ গড়ার কারিগরেরা। অনশনে থাকতে থাকতে ১৪ জন শিক্ষক এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়েছে অসুস্থদেরকে। অনেকেরেই স্যালাইন চলছে প্রেসক্লাবের সমানের ফুটপাথে। এ দৃশ্য দেখা যায় না। এ দৃশ্য সহ্য করা যায় না দেখে। আহা রে আমাদের মানুষ গড়ার কারিগরগণ! কি অমানুসিক কষ্ট বুকে নিয়ে এই শীতের রাতে তারা ফুটপাথে পড়ে আছেন। একমুঠো ভাতের নিশ্চয়তায়। দু বেলা দু মুঠো খেয়ে পড়ে বাঁচার আশায়। তারা কোটি টাকার গাড়ি, লাখ টাকার বাড়ি চান না। তারা চান আর দশটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মতো তাদের হাতেও মাস গেলে বেতনের টাকাটা উঠুক। তাই দিয়ে কোনো রকমে টেনেটুনে চলে যাক তাদের সংসার।
সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন যেখানে কয়েক দফায় কয়েকগুণ করে বেড়েছে, সেখানে ৮০-৯০ হাজার শিক্ষকের মাসিক বেতনের ব্যবস্থা করা কি সরকারের জন্য খুবই বড় বোঝা? যদি বোঝাই হবে, তবে এসব স্কুল মাদ্রাসাগুলোর অনুমোদন দেওয়া হলো কেন? তারা অনুমেlদন পেল কি করে? স্কুল নেই, চাকরী নেই, বেতনও নেই, সেই তো ভালো ছিল। স্কুল খোলার অনুমোদন দিয়ে এভাবে তাদের অনহারে মারবার এ আয়োজন কেন?
অনশনে অংশ নেওয়া একজন শিক্ষকের কথা শুনছিলাম টিভিতে। বয়স চল্লিশ-পয়তাল্লিশের কম হবে না। চোয়ালমুখ ভেঙে গেছে। দেখেই বোঝা যায় দারিদ্রের করাঘাতে জর্জরিত জীবন। এই লোকটিই ক্লাসে বসে হয়ত পড়ান উন্নয়নের রোল মডেল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে দেশ কতটা সাবলম্বী হয়েছে, কতটা এগিয়েছে, তাই হয়ত নানান উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন কোমলমতী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে। মুখে উন্নয়নের এই গল্প শোনালেও অন্তরে জ্বলে তার তীব্র দহন। সারা মাস পড়িয়ে মাস শেষে যখন বাজারের টাকাটাও ওঠে না হাতে, তার কাছে এই উন্নয়নের মূল্য আর থাকে কী? কিসের আশায় তারা বছরের পর বছর ধরে পড়িয়ে যাচ্ছেন? শিক্ষক ভদ্রলোক কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন- শিক্ষকতা করতে এসে ছেলে মেয়েদের সামনে দাঁড়াতে পারি না লজ্জায়। তাদের প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ আমার নাই। আর কত সহ্য করব? হয় বেতনের ব্যবস্থা করবে সরকার, না হয় এইখানেই মরে যাব!
তার সাক্ষাতকারটি দেখে বুকের ভেতরটায় হু হু করে উঠল আমার। কতটা নিলর্জ্জ জাতি হিসেবে আমরা। আমার বাবা একজন শিক্ষক। সংসারে অভাব কাকে বলে দেখেছি সেই ছোট্ট বেলা থেকে। যদিও তার কপাল কিঞ্চিত ভালো, তিনি এমপিওভুক্ত। তারপরও ছোটবেলা থেকে দেখছি, তার দৈন্য দশা। সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা মাসের শেষ হতে না হতেই বেতনের কড়কড়ে টাকা হাতে ঘরে ফেরেন। ওদিকে এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকদের বেতনের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। জুনের বেতন হয় জুলাইয়ের শেষে। জানুয়ারির বেতন মার্চ মাসেও হয় না কখনো কখনো। সরকারি কর্মচারী করমকর্তাদের উতসব ভাতা, বোনাস নির্দিষ্ট সময়ে হলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেলায় তার খবর নেই। অনেকবার ঈদের আগে বাবা শুকনো মুখে জানিয়েছেন, এবার ঈদের কেনাকাটা বন্ধ। বেতন হয়নি। বোনাস হবে ঈদের পর। কি যে অসহ্য বেদনা তখন বাবার চোখেমুখে ঘুরে ফিরতে দেখেছি। কি যে অসহায় হয়ে পড়তেন তিনি আমাদের সামনে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবস্থাই যদি এইরূপ হয়, নন এমপিওদের কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দরিদ্র শিক্ষদের মধ্যে তারা অতিদরিদ্র।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বছর বছর বাড়ছে বাজেটের আকার। বাড়ছে শিক্ষাখাতের বরাদ্দও। কেবল বরাদ্দ বৃদ্ধিই মূল কথা নয়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষাখাতের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ শিক্ষার মূল কারিগর শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে সর্বাগ্রে। শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়েনর জন্য দারিদ্র পিড়ীত আদর্শ শিক্ষকের যে ট্যাবু যুগযুগ ধরে চলে আসছে, তা ভাঙতে হবে। যারা গড়বেন, তার পেটেই যদি ক্ষুধা থাকে, ওষুধ কেনার টাকা যোগাড়ে তারই যদি টেনশনে ঘুম না হয়, তবে আর কী গড়বেন তিনি? বাংলাদেশের মতো কম বেতনে পৃথিবীর আর কোন দেশে শিক্ষকরা চাকরী করেন বলে আমার জানা নেই। এভাবে চলতে পারে না। একটি জাতির ভিত গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব যাদের কাঁধে তাদের বিষয়ে এতটা দায়িত্বহীন হলে চলবে না। সুষ্ঠুভাবে তাদের জীবন ধারণের বন্দোবস্ত রাষ্ট্রকেই করতে হবে।
আন্দোলনরত নন-এমপিও শিক্ষকদের দাবী মেনে অতি দ্রুত তাদের বিদ্যালয়ে ফেরনো বন্দোবস্ত করার দাবী জানাই।
লেখক: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।