প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আবেগমথিত ভালোবাসার নাম!
আমাদের ভালোবাসার ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ জন্মদিন আজ। ছেচল্লিশ বছর আগে ১৯৭০ সালের এই দিনে ঢাকার অদূরে সাভারের বনবীথিকাপূর্ণ এক নিভৃত গ্রামে দেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই বিদ্যাতয়নটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে অনেক প্রথিতযশা বিদগ্ধজনরা যেমন গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন, তেমনি এখানকার শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সেক্টরে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ চত্বরে সমাবেশ, দিবসের বর্ণিল উদ্বোধন ও বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রার মাধ্যমে ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিবসটি পালন করছে। দীর্ঘজীবী হও প্রাণপ্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি গণিত, ভূগোল, অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান বিভাগ এবং ১৫০ শিক্ষার্থী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্তত ১৪ হাজার। ছয়টি ফ্যাকাল্টি, ৩৬টি বিভাগ এবং পাঁচ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড সেন্টার। ৮০০ শিক্ষক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করেন।
৩০০ হেক্টর ভূমির জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে চিরকালের জন্য অপার মায়া। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বলেই এখানকার শিক্ষার্থীদের একে অপরের সঙ্গে এবং ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক বয়ে বেড়ায়। যে সৌহার্দ্য ও মমতার বন্ধন অটুট থাকে আজীবন। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন, জাহাঙ্গীরনগর একটা দৃপ্ত ‘ইজমে’র নাম। কোনোদিন চলতি পথের বাঁকে চকিতে কারো সঙ্গে দেখে হয়ে গেলে জাহাঙ্গীরনগরিয়ান নাম শুনলেই যুগল প্রাণ আনচান করবেই। সেখানে সিনিয়র-জুনিয়র বলে কোনো ব্যারিয়ার নেই। এমন মানবিক মায়ার বন্ধনের শেকড় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিতে, প্রতিটি সবুজ ঘাসের ডগায়, লাল সিরামিকের প্রতিটি ইটে বা লাল শাপলাশোভিত লেকের জলকণায় প্রোথিত তা অবিনাশী। আমরা সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসি। যার নজির মিলেছে সদ্য সমাপ্ত সিনেটে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনে। সারা দেশ থেকে ভোটাররা এসে তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ করেছে। সেখানে ভেতরের কোনো কন্সপিরেসি যদিও বা থেকে থাকে সকল রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটের প্রাণবন্ত মিলনমেলার কাছে তা ম্লান। শিক্ষায়নের প্রতি আমাদের এমন নিরঙ্কুশ প্রেম কি বিশ্ববিদ্যালয় টের পায়?
যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত কবি সৈয়দ আলী আহসান, লোকসাহিত্যিক মজহারুল ইসলাম, লেখক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, লেখক হায়াত মামুদ, লেখক হুমায়ূন আজাদ, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক, অধ্যাপক মোস্তফা নূরুল ইসলাম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরীর মতো মেধাবী মুখ, সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন আসলে কেমন চলছে?
বাংলাদেশের প্রথম নৃবিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের একমাত্র প্রত্নতত্ত্ব বিভাগও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলার নিজস্ব নাট্যরীতি, বর্ণনাত্মক নাট্যধারা, এথনিক কিংবা ফিউশনধর্মী নাট্যগবেষণা এবং উয়ারী-বটেশ্বরের মতো প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য অর্জন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এরশাদ সরকার আমলে শিক্ষা আন্দোলন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ধর্ষক মানিকবিরোধী আন্দোলন কিংবা যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধ্বে আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগরিয়ান শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ব্যাপক। সর্বশেষ গেল বছর সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় প্রশাসনিক দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি নতিস্বীকারে বাধ্য হয় প্রশাসন।
২০১৪ সালের ২ মার্চ থেকে অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ভিসির মেসেজ হিসেবে শোভা পাচ্ছে ২০১২ সালের তথ্য ও পরিসংখ্যান! এটা চূড়ান্তরকমের অনগ্রসরতা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দেখতে দেখতে ৪৬টি বছর পার হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছেন। আপনারা যে যেখানে থাকেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবেসে এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সম্মান এনে আপনারা নিজেদেরকে, আমাদেরকে, সকলকে সম্মানিত ও গৌরাবান্বিত করবেন।‘
নিশ্চিতার্থেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্মানিত ও গৌরবান্বিত করবার। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দায়িত্ব বর্তায় বর্তমান প্রশাসন, সিন্ডিকেট ও সিনেটের ওপর। ’৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ নামে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি সংবিধান রয়েছে। কিন্তু সেই বিধান কি কিঞ্চিতার্থেও মেনে চলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? অভিযোগ উঠেছে, দেশের অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জাহাঙ্গীরনগরেও শিক্ষাকে দিনদিন বাণিজ্যিকীকরণ করে ফেলা হচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগে খোলা হচ্ছে ‘উইকেন্ড’ কোর্স। ক্যাম্পাসের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, শুধু বিভিন্ন বিভাগের মাস্টার্স কোর্স চালু রাখতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে সপ্তাহে দুদিন শুক্রবার ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির নিয়ম চালু করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এই ব্যাপারটি বিদ্যমান আছে। সে ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর ব্যতিক্রম কিসে?
সপ্তাহে দুদিন ছুটি থাকার বিধানের সঙ্গে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শিক্ষকদের ক্লাস পরীক্ষায় সময় দেওয়ার কথা থাকলেও অনেক শিক্ষকই নাকি ১টা বা ৩টার বাসে ঢাকায় পাড়ি জমান। এমন পরিস্থিতিতে অনিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় তীব্র সেশনজটের মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র হয়ে উঠবার যোগ্যতা অর্জন করেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় বিবেচনায় ‘উইকেন্ড’ শিক্ষার্থীদের কাছে একজন নিয়মিত ছাত্রের মর্যাদার মারাত্মক অবনমন ঘটে তা কি প্রশাসন ঠাওর করতে পারে? মাস্টার্স এমফিল বা পিএইচডির মতো গবেষণামূলক শিক্ষা নয়, দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সহস্র কলেজে মাস্টার্স পড়ানো হয়–এমন বাস্তবতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘উইকেন্ড’ পাঠের মতো বিতর্কিত বিদ্যাধর হতে হবে কেন?
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলাদলি ও রেষারেষি চরম আকার ধারণ করেছে। নিজেরা ‘লাল’, ‘সাদা’, ‘গোলাপি’ বর্ণে পরিচিত করাচ্ছেন। সাধারণ শিক্ষক সমাজের কথা বলব না, দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে গা ভাসানো শিক্ষকরা অতি কাঙ্ক্ষিত পদ বাগাতে মারামারিতে পর্যন্ত লিপ্ত হন। জাহাঙ্গীরনগরও এই স্রোতের বাইরে নয়। অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা/কর্মচারী নিয়োগে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নয়, প্রাধান্য পায় দলীয় পরিচয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাধর শিক্ষক কর্মকর্তাদের আত্তীকরণসূত্রের। বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি শিক্ষক তাঁর স্ত্রী বা অন্য স্বজনরাই সেখানকার কর্মকর্তা। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি।
শিক্ষাবাণিজ্য ও দলাদলির মতো এমন অশুভ রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষা,পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক ও যোগ্যতম মানুষ গড়ে তুলতে এই তিন বিষয়ের বিবেচনাই সবার আগে থাকা উচিত।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ সালে আমেরিকার শিকাগো থেকে নিজ জ্যেষ্ঠপুত্র এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি চিঠিতে বলেছিলেন, ‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে–ওইখানে সর্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে–স্বজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে–ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ওই বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।‘ কিন্তু আমরা কি কবিগুরুর মতো করে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃতার্থেই মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্রে রূপান্তরের কথা কখনো ভাবতে পেরেছি?
বিশ্বকবি নিজের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনকে কখনো রাজনৈতিক ভাবনা বা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়াননি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সচেতনভাবেই রাজনীতিমুক্ত রাখবার প্রয়াস পেয়েছেন তিনি। পক্ষান্তরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতি চর্চা এমনভাবে আসন গেড়ে আছে যে, সেই আসনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের না বসে উপায় নেই।
তারপরও শত প্রতিকূলতা কিংবা নেতিবাচকতা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার গর্ব। এমন প্রাণপ্রকৃতি ও উদ্ভিদরাজির সমারোহ নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এত সুন্দর, এত মোহনীয় বিদ্যায়তনিক ক্যাম্পাস পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসা প্রিয় অতিথি পরিযায়ী পাখিরাও তা জানে। খ্যাতিমান নাট্যকার ড. সেলিম আল দীন জাহাঙ্গীরনগকে বলতেন সাংস্কৃতিক রাজধানী। আমরা তেমন এক রাজধানীর বাসিন্দা হিসেবে রাবীন্দ্রিক সুরে বুক ফুলিয়ে বলতেই পারি :
এসো আমার ঘরে।
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে॥
স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে
মুগ্ধ এ চোখে।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।