অভিমত
ছন্দে কি সব অন্যায় বাঁধা সম্ভব?
আজকাল সংবাদপত্রের শিরোনামে ছন্দ ঢুকে গেছে, অন্ত্যমিল ঢুকে গেছে, তাল ঢুকে গেছে। পাঠককে টানার এ কৌশলটা নতুন নয়, আগেও এ রকম ছন্দোবদ্ধ শিরোনাম ব্যবহার হয়েছে। তবে ইদানীং দেখে মজাই পাচ্ছি।
ছড়া লিখে আনন্দ পাই। মন ভালো হয়ে যায় ছড়া ছাপা হলে। সেই ১৯৮৪ সালের প্রথমবার নিজের নাম ছাপা হওয়ার পর যে রকম আনন্দ পেয়েছিলাম, এখনো সেই একই আনন্দ অনুভব করি, বুকের গহিনে। আহারে ছড়া।
একটি শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় গত ১১ জানুয়ারি খবর প্রকাশিত হয়। শিরোনামটি এ রকম
‘চাকরি-টাকায় বুঁদ
সাংসদ ওয়াদুদ।’
যেকোনো পাঠককে টানবে এই শিরোনামটি। তবে পুরো খবরটি পড়ে হতাশ হবেন অনেকে। সরকারদলীয় একজন সাংসদের নীতি-নৈতিকতার অবস্থা এত খারাপ। টাকা ছাড়া যিনি কিছুই বোঝেন না। রাজশাহীর পুঠিয়া-দুর্গাপুরের এই সাংসদ তাঁর এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য পাঁচ থেকে সতের লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন একেকজনের কাছ থেকে। ১৫ জন মানুষ ওই শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকের সাংবাদিকের কাছে অভিযোগ করেছেন সাংসদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই না, স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতা তাঁর দুর্নীতির কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন।
জানা গেছে, চাকরি দেওয়ার কথা বলে একটি পদের জন্য একাধিক লোকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো। যে বেশি টাকা দিতে পারত তার চাকরি হতো। যারা টাকার অঙ্ক কম দিত সেই টাকা তুলতে অনেককে এখনো হয়রানি পোহাতে হচ্ছে। সাংসদের কাছে সেই টাকা চাইতে গেলে বলে দেন, রাজনীতি করি, টাকা খরচ হয়ে গেছে। তবে অনেকের টাকা আবার ফেরতও দিয়েছেন।
তাঁর এলাকায় গত ৯ বছরে ৭০০ নিয়োগ হয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এসব নিয়োগে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন সাংসদ। টাকা-পয়সার লেনেদেনে জড়িত ছিলেন তার ভাই, চাচা এবং স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা।
বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে যখন সাংসদের মতামত চাওয়া হয় তখন তিনি যা বলেছেন তা হলো এরকম ‘সব মিথ্যা’। আরেকটি অভিযোগ সম্পর্কে সাংসদের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ ছিঃ ছিঃ এ ধরনের কথা আপনি শুনেছেন, আমাকেও শুনতে হচ্ছে, এসব মিথ্যা।’
সাংসদের এ ধরনের উত্তর শুনে মনে হয়, সাংসদ সম্পর্কে তার এলাকার একদল বাজে মানুষ মাঠে নেমেছে, তাকে হেয় করার জন্য। আদতে এত এত অভিযোগ সব ডাহা মিথ্যা।
তাহলে কি তাঁর এলাকার নিজ দলের নেতাকর্মীরা সবাই খারাপ?
সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়ে ওই সাংসদ সম্পর্কে অনেক কথা শুনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন।
প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সাংসদ সম্পর্কে কথা শুনে বিব্রতই হন উপদেষ্টা, তাহলে কেন ঢাকায় ফিরে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি?
আবার ফিরে আসি ছড়ায়। ছন্দোবদ্ধ সংবাদপত্রের শিরোনাম আমাদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু যাদের নজরে আসার কথা, তাদের কি নজরে আসে? দেশে ওই রকম সাংসদের সংখ্যা অনেক। কজনের কথা ওরকম ছন্দে ফেলে শিরোনাম করবেন একজন সাংবাদিক? ছন্দেরও তো সীমাবদ্ধতা আছে। মিটার আছে। বর্ণ সংখ্যা আছে সীমিত। সবার কথা কি আটকানো যাবে ছন্দের বাহাদুরীতে?
আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনেক জনপ্রতিনিধি অনেক অন্যায় করে চলেছেন। কে দেখবে তাদের? বিড়ালের গলায় আজ ঘণ্টা কে বাঁধবে? ছন্দে কি সব অন্যায় বাঁধা সম্ভব?
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।