যশোর রোড
বৃক্ষের অভিসম্পাত কেমনে বইবে মানব সভ্যতা?
ঐতিহাসিক যশোর রোডের দুই হাজার ৭০০ বৃক্ষের প্রাণ এখন ঝুলে আছে সড়ক বিভগের ইচ্ছা-অনিচ্ছার চারদেয়ালে। কী ধর্ম, কী নীতিশাস্ত্র অথবা মানবিকতা সবখানেই বলা আছে প্রাণ বাঁচানো কর্তব্য। আর সেই প্রাণ যদি পরিবেশ –প্রকৃতি কিংবা শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জীবন রক্ষার বড় অনুষঙ্গ হয়ে থাকে তবে তা বাঁচানোটা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু আমাদের সরকারি আধিকারিকরা মানবিকতা, বোধ কিংবা দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে সবসময় ভাবেন এমনটা নয়। আমরা যদি একবার ভাবি, পৌনে ২০০ বছরের প্রাচীন বৃক্ষগুলোর বুকে যখন কুঠার বা করাত চালানো হবে তখন তাদের অনুভূতিটা কেমন হবে? মনটা কার না বিষণ্ন হয়ে ওঠে?
উদ্ভিদের প্রাণ আছে, ওদের টিস্যু ব্যাপক উত্তেজনা অনুভব করে, যার সাথে প্রাণিজগতের প্রচুর সাদৃশ্য আছে এটা এখন বাস্তবতা। বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর আবিষ্কৃত একটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন জীব ও প্রাণিজগতের মতো উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। উষ্ণতা, আলো-বাতাস, শব্দ, ধ্বনি ও প্রতিধ্বনির সাথে উদ্ভিদ বা গুল্মরাজিও চেতনা অনুভব করে। জগদীশ চন্দ্র বসু আবিষ্কৃত ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ ব্যবহার করে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণের মাধ্যমে আমরা যশোর রোডের বৃক্ষরাজির মন খারাপের গল্প পুরো জাতিকে শোনাতে চাই। ওরা ওদের ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবে নিশ্চিতই কাঁদে। কিন্তু আমরা বুদ্ধিমান মানুষ সেই মন কেমন করা কান্নার কারুণ্য অনুভব করতে পারি কি?
বিখ্যাত যশোর রোড নিজেই এক বিরাট ইতিহাস। সেখানকার বৃক্ষরা সেই ইতিহাসের সবুজ পাতা। ২০০ বছর আগের যশোরের জমিদার কালী প্রসন্ন রায় তথা কালী পোদ্দার বাবু ১৮৪০ সালে তাঁর মায়ের গঙ্গা স্নানের সুবিধার্থে যশোর থেকে নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেকালে সড়কটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল দুই লাখ ৫৮ হাজার ‘কড়ি’। পরে কালী পোদ্দারের মা যাতে সবুজ বৃক্ষের ছায়ায় ছায়ায় গঙ্গাস্নানে যেতে পারেন সেজন্য রাস্তার দুই ধারে তিনি বিদেশ অতি বর্ধনশীল রেইনট্রির চারা এনে রোপণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ৮০ কিলোমিটার সড়কের ৪২ কিলোমিটার পরে ভারতের অংশে আর বাকি ৩৮ কিলোমিটার সড়ক এখন যশোরের বকচর থেকে বেনাপোল চেকপোস্টের শূন্য রেখা পর্যন্ত পণ্য পরিবহন ও মানুষের যাতায়াতের জনপ্রিয় পথ। যে পথ ধরে ছায়ায় ছায়ায় গঙ্গাস্নানে যেতেন জমিদারের মা, সেই পথের ছায়ায় পৌনে ২০০ বছর ধরে প্রাণ জুড়িয়ে চলেছেন আপামর সাধারণ মানুষ। এক মায়ের আশীর্বাদ ধন্য মহীরুহরা এখন পর্যন্ত সব মানুষের সখা।
ক্রমপরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বাংলাদেশেও অনেককিছু বদলে যাচ্ছে। বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে গাড়ি আর প্রসার হচ্ছে বাণিজ্যের। তাই যশোর রোড এখন সম্প্রসারণ করতে হবে। আর বিস্ময়কর হলেও সত্য সেই সম্প্রসারণের বলিই কি না করা হবে প্রায় তিন হাজার বৃক্ষকে। দেশের ইতিহাসে এত পুরোনো গাছ একসাথে কেটে ফেলার নির্বুদ্ধিতা এর আগে আর দেখা যায়নি। অথচ পরিকল্পনায় সামান্য হেরফের করলেই গাছগুলোর প্রাণে হাত না দিয়ে দৃষ্টিনন্দন সড়ক বানানো যায়। যাতে ইতিহাসও টেকে, টেকে এক মায়ের মতো করে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে বিশুদ্ধ অক্সিজেন, দৃষ্টিতে সবুজের মায়া এবং রেইনট্রির ঝিরিঝির বৃষ্টির স্বভাবকে মাথায় নিয়ে সাধারণের পথচলবার আনন্দও।
সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে ইতিমধ্যে একনেকে ৩২৩ কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সড়কটি মালিকানা নিয়ে যশোর জেলা পরিষদ সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাথে রশি টানাটানিও চলছে। পুরোনো গাছ কেটে সড়ক উন্নয়ন করতে এমন সিদ্ধান্তের সাথে সড়ক বিভাগ ছাড়া আর কেউ সহমত পোষণ করেনি। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল গণমাধ্যমকে বলেছেন, যশোর-বেনাপোল, যশোর-খুলনা, যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের জমি যশোর জেলা পরিষদের মালিকানাধীন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে সড়কের যাবতীয় উন্নয়ন কাজ, বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব জেলা পরিষদ পালন করে আসছে। আমরা উন্নয়নের বিরোধী নই। উন্নয়নও করতে হবে, আবার গাছও রক্ষা করতে হবে। রাস্তার দুই পাশের গাছ কেটে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা ঠিক হবে না। উন্নয়নের স্বার্থে যদি গাছ কাটাই লাগে, তাহলে একপাশের গাছ কেটে অন্য পাশেরগুলো রাখা হোক। কারণ এগুলো অনেক পুরোনো গাছ, আমাদের ঐতিহ্যও জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে।’
গাছ কেটে সড়ক প্রশস্তকরণ প্রসঙ্গে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাইবুর রহমান মোল্লা গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘একসঙ্গে এত গাছ কেটে ফেলা ঠিক হবে না। এতে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাবে; অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেবে। আর বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে তা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলায় গাছ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই গাছগুলো না কেটে কীভাবে উন্নয়ন কাজ করা যায়, তা ভেবে দেখা দরকার।’
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, কলকাতার রাজ্য সরকারও রাস্তা প্রশস্ত করার নামে আমাদের মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে কাটা পড়ছে অন্তত চার হাজার গাছ। যাদের কোনো কোনোটির বয়স আবার ৩০০ বছর। সেখানে অবশ্য পরিবেশবাদী, শিল্পী, সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আন্দোলন হচ্ছে যাতে গাছগুলোর ওপর করাত-কুঠারের আচর না পড়ে। বাংলাদেশ সরকার হয়তো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারে।
অবশ্য এ ব্যাপারে যশোর-১ (শার্শা) আসনের সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, বেনাপোলের ওপারে ভারতীয় অংশের এই রোডটি চার লেনের। ওখানে শতবর্ষী গাছগুলো সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে চার লেনের মাঝখানে। গাছগুলো রাস্তার সৌন্দার্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সাংসদের এ কথা যদি সত্য হয়ে থাকে বাংলাদেশ সরকারও তেমন একটা ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারে যাতে গাছগুলোকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে বাঁচানো যায়।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ট্র্যাজিক ইতিহাসের সাথেও এই যশোর রোডের নাম জড়িয়ে আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশি শরণার্থীরা রাস্তার দুধারের ওই গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। ওই রাস্তাধরে মিত্রবাহিনীরা এসেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে। এই সড়ক ধরে ওপারে গিয়ে কলকাতার বনগাঁইয়ে আশ্রয় নিয়েছিল হাজারো শরণার্থী। স্বদেশ-স্বজনহীন শরণার্থীরা যারা যশোর রোড দিয়ে ওপারে গিয়েছিল তাদের মানবেতর জীবনের মর্মগাঁথাকে উপজীব্য করে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘September in Jessore Road’ -শিরোনামে তাঁর বিখ্যাত কবিতাটি লিখেছিলেন :
Millions of souls nineteen seventyone
homeless on Jessore road under grey sun
A million are dead, the million who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan…
বাঙালি শরণার্থীদের সহায়তার জন্য যে কবিতাটিকে পরে গানে রূপান্তরিত করে কিংবদন্তি শিল্পী বব ডিলানের সহায়তায় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ গাওয়া হয়েছিল। ওপার বাংলার জনপ্রিয় শিল্পী মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে বাংলা হয়েও বেজেছিল ঐতিহাসিক গানটি :
যশোর রোডের দুধারে মানুষ এত এত লোক শুধু কেন মরে।
শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত শিশু মরে গেল,
যশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
এমনতর হাজার ঘটনার সাক্ষী একটি সড়ককে হঠাৎ ন্যাড়া করে দিয়ে তার আসল চিত্রপট পরিবর্তন করে দেওয়া আর যাই হোক আমাদের মতো শেকড় সন্ধানীদের জন্য অরুচিকর ও অনভিপ্রেত। আমরা চাই কালোত্তীর্ণ ইতিহাসের সাক্ষী এই বৃক্ষরাজিকে যেকোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখা হোক। পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী গাছ সংরক্ষণের জন্য ‘বৃক্ষ সংরক্ষণ আইন-২০১৬’ নীতিগত অনুমোদন পেয়েছিল মন্ত্রিসভায়, ২০১৬ সালেই। এই আইনের চূড়ান্তরূপের বাস্তবায়ন কি আর কোনোদিন হবে?
মানছি এখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যুগ নয়। কিন্তু এটা যদি সত্য হয় তার আমলের মানুষের চেয়ে এখনকার মানুষ প্রাগ্রসর চিন্তা করে। তাহলে প্রাণদায়িণী বৃক্ষের ওপর নিষ্ঠুর মানুষ কোপ দিতে চায় কোন জ্ঞানে? স্বাভাবিক প্রকৃতিকে আমলে না নেয় কীভাবে?
কীভাবে প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হলো এ প্রসঙ্গে ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে কবিগুরু বলেন, ‘ মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্য সম্পদ রক্ষা করাই সর্বত্র সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিধাতা পাঠিয়েছিলেন প্রাণকে, চারদিক তারই আয়োজন করে রেখেছিলেন। মানুষ নিজের লোভের দ্বারা মরণের উপকরণ জুগিয়েছে। বিধাতার অভিপ্রায় লঙ্ঘন করেই মানুষের সমাজে আজ এত অভিসম্পাত।‘ ‘তপোবন’ প্রবন্ধে রবি ঠাকুর বলেন, ‘একসময় এই ভূখণ্ডে মানুষ আর গাছপালা একে অপরের সঙ্গে জরাজড়ি করে থাকত তা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে।‘ তাই জীবনকে আনন্দের সাথে বাঁচিয়ে রাখতে এবং মানব সভ্যতার প্রতি অভিসম্পাত দূরীভূত করতে ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় কবি দৃপ্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন :
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি,...
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন