দৃষ্টিপাত
প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের গুলি করার হুমকি!
‘এমবিবিএস পড়তে আইছো না? পাবনা জানো না বন্ধ কইরা দিসে, তাতে (রগচটা বাঙালির প্রিয় একটি ‘ব’ বর্গীয় গালি!) হইসে! কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ টোটালই বন্ধ কইরা দিসে, তাতে অথোরিটির কী হইসে, প্রিন্সিপালের কী হইসে? তোমাদের একবছর লস হবে, এক্সপেল করা হবে!... আমার সঙ্গে রয়েছে সরকার। যারাই ইতরামি করবে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেবে!’
এমন হুমকি এবং অশ্রাব্য মুখের ভাষা একজন সাবেক সংসদ সদস্যের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এম মকবুল হোসেন তথা হাজি মকবুল এইচ এম শমরিতা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান। ওই মেডিকেলের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে বছরখানেক ধরে আন্দোলন করে আসছিল শিক্ষার্থীরা। সেসব আন্দোলন বা দাবি দাওয়ার দিকে নজর না দিয়ে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ অনিয়মের প্রতিবাদ করায় সম্প্রতি উলটো লিমন নামের এক ইন্টার্ন চিকিৎসককে বহিষ্কার করে।
ইন্টার্ন ওই চিকিৎসকের বহিষ্কার আদেশ বাতিল, ইন্টার্ন এমবিবিএস চিকিৎসকদের ভাতা ১৫ হাজার এবং বিডিএস চিকিৎসকদের ভাতা ১০ হাজার টাকা করা, প্রতিবছর মাসিক বেতন বাড়ানো বন্ধ করা, ফাইনালে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের থেকে বিএনডিসির নিয়ম বহির্ভূত ৭৮ হাজার টাকা নেওয়া বন্ধ করা, যে কোনো পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত ফির বাইরে বাড়তি ফি না নেওয়া, মাসিক বেতন দেওয়ার সর্বশেষ তারিখ প্রতিমাসে ১০ তারিখ করাসহ ৮ দফা দাবিতে এইচএম শমরিতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শতাধিক শিক্ষার্থী তেজগাঁওয়ে কলেজ ক্যাম্পাসের সামনের রোববার সকালে রাস্তা অবরোধ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় অবস্থান করে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন ওই মেডিকেলের চেয়ারম্যান হাজি মকবুল। এসেই তিনি পুলিশের সামনেই শিক্ষার্থীদের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে খুলি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। একপর্যায়ে মারিয়া নামের এক শিক্ষার্থীকে আন্দোলন করলে আর হোস্টেলে উঠতে দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেন। এ সময় তাঁর কলেজের প্রিন্সিপাল, শিক্ষক ও অন্য স্টাফরা চেয়ারম্যানের সাথে হাত নাচিয়ে নাচিয়ে সায় দিয়ে যান। হাজি মকবুলের অশালীন ভাষার প্রয়োগ, সন্ত্রাসী কায়দায় হুমকিধমকির ভিডিও এখন ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের নেট ভার্সনে ঘুরছে। হাজি মকবুল আমাদেরকে দেখিয়ে দিলেন, কাদের মতো লোক আসলে বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ চালাচ্ছে? চিকিৎসাবিদ্যা মানেই পুরোদস্তুর মানবসেবা। একজন মকবুল যিনি কথায় কথায় বছর বছর বেতন বাড়ান, নানা ছুতোয় শিক্ষার্থীদের পকেট কাটেন, সর্বোপরি ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবির প্রতি দৃষ্টিপাত না করে নিজের চরিত্রের স্বরূপ চিনিয়ে দেন– এমন একজন নামমাত্র মানুষের প্রতিষ্ঠান থেকে আদৌ কি সেবক বের হবে?
আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৬ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাজি মকবুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ৬ মে সংসদ ভবনের বিশেষ আদালত তাঁকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। অবশ্য পরে তাঁর ১৩ বছরের সাজা বাতিল ঘোষণা করেন বিচারপতি এম এ হাই ও বিচারপতি মো. আব্দুর রাজ্জাকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। হাজি মকবুল সংসদ সদস্য থাকাকালীন তাঁর এবং তাঁর স্বজনদের কর্মকাণ্ড মানুষ এখনো ভুলেনি।
তো এই হলো একজন মকবুলের অবস্থা! তিনি সাবেক এমপি হয়েছেন তো কী হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ‘অ্যাটেম্প টু মার্ডারে’র জন্য, মানসিক অত্যাচার করবার জন্য, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের হুমকি দেওয়ার জন্য এখনো কেন তাঁর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হবে না? স্বয়ং পুলিশই তো রাজ সাক্ষী! দেশে আছে কোনো আইন?
মকবুলের হুমকির পর শিক্ষার্থীরা আরো ফুঁসে উঠলে চাপের মুখে কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে নেওয়ার সম্মতি দিতে বাধ্য হয়। বিকেলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসে। কিন্তু আমরা জানি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো কিছুতেই শিক্ষার্থী ও রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অসাধুতামুক্ত হতে পারবে না। লোভ দাবানলের মতো, একবার জ্বলে উঠলে তা আর সহজে নেভে না।
দেশে বর্তমানে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৬২টি। সরকার হয়তো নিজেদের মুখচেনা লোকদের আরো ব্যাঙের ছাতার মতো মেডিকেল প্রতিষ্ঠা করতে দেবে। এসব মেডিকেলে আসন সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ ১৮টি, আসন সংখ্যা এক হাজার ২০০। বিস্ময়কর হলেও সত্য কয়েক বছর আগেও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি গড়ে ১৫ লাখ টাকা এবং ডেন্টালে ভর্তি ফি নেওয়া হয় গড়ে ছয় লাখ টাকা নেওয়া হতো! যারা সরকারি মেডিকেল কলেজে চান্স না পায় তাদের অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শুধু ব্যয়ভার বহনের কথা মনে করে বেসরকারি মেডিকেলে পড়ার স্বপ্নও দেখতে পারে না। এমন বাস্তবতায় সরকারি তরফে ভর্তি ফি কমানোর কথা না বলে ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ভর্তি ফি নির্ধারণ নিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন দেয়। সেখানে বলা হয়, ২০১৪—১৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রী ভর্তি ফি ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা । ইন্টার্নি ভাতা এক লাখ ২০ হাজার টাকা। টিউশন ফি চার লাখ ৮০ হাজার টাকা। সর্বমোট ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
এত টাকার কথা চিন্তা করে প্রতিবছরই বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো সোনার হরিণ খোঁজার মতো আসন সংখ্যা পূরণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তাই শিক্ষার্থীদের মেধাস্কোর ১২০ থেকে কমিয়ে ১০৫ বা তারও নিচে নির্ধারণ করে দেওয়ার মতো অদ্ভুত দাবি তুলছে তারা। এমনকি তারা বলছে, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেই তাদের যেন বেসরকারি মেডিকেলে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়! এর অর্থ একটাই মেধাহীনেরা ডাক্তার হবে আর দুর্নীতিবাজ ও অসাধুরা লাভবান হবে।
সরকার ও নীতি নির্ধারকদের কাছে প্রশ্ন –যে শিক্ষার্থীটি ২০-৩০ লাখ টাকা খরচ করে ডাক্তারি পেশায় নাম লেখাবেন তাঁর আসলে পুষাবে কীভাবে? ঘুরেফিরে আবার সেই রোগীর পকেট কাটতে বাধ্য হবেন একজন ডাক্তার। রাষ্ট্রই তাদের এমন সুযোগ করে দিচ্ছে। হাজি মকবুলের রূঢ় আচরণ, মেডিকেল কলেজের অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে করতে শিক্ষার্থীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া, ঘরে ঘরে ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা মানহীন চিকিৎসালয় গড়ে ওঠা, ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়া, ডাক্তার-রোগীর দা-কুমড়ো সম্পর্ক সবই একসূত্রে গাঁথা।
আমরা চাই, হাজি মকবুলের মতো বাণিজ্যিক মনোভাবাপন্ন মানুষ মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক না হোক। সেবাপরায়ণ কোনো মানুষের কাছে বেসরকারি মেডিকেল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ভার দেওয়া হোক। যেখানে আর্থিক সামর্থ্য বিচারে শুধু মেধাবীরাই পড়াশোনা করবে। প্রতিবাদীর খুলিতে গুলি করে নিজের ক্ষমতা জাহির করবেন– দেশে এমন সমাজবিরোধী মানুষের স্থান না থাকুক।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন