অভিমত
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও কিছু প্রশ্ন
গত দুইবছর সময়ের মধ্যে যেসব রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেছেন, ফেরত যাবেন নিজ দেশে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা এসেছেন কেবল তাঁরাই যাবেন, আগে যেসব রোহিঙ্গা এসেছেন তাঁরা নন। ঠিক আছে, ভালো কথা। বাংলাদেশ অবশেষে কাজটি করতে সক্ষম হলো। এতে দুটি বিষয় প্রমাণিত হলো। এক. এই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদের ফেরত নিতে দেশটি কাগজে-কলমে একমত হলো। দুই. দেশটি তাদের সেনাবাহিনীর অপরাধও মেনে নিল।
২০১৮ শুরু হলো মাত্র। এখন দেখার বিষয়, পরবর্তী দুই বছর সময়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশের নির্বাচন এ বছরের শেষের দিকে। আর, মিয়ানমারের নির্বাচন ২০২০ নাগাদ। যদি তাই হয়, তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কী হবে? মানে, এই যে প্রক্রিয়ায় সম্মত হলো দুই দেশ, সেটি কি বহাল থাকবে নাকি পরিবর্তন হবে? কারণ, বাংলাদেশে যখনই সরকারের স্থানে দুটো বড় দল বসে, তার সঙ্গে সঙ্গে সবই পরিবর্তিত হয়। যদিও এ দেশে ভোটকে গণতন্ত্র চর্চার উদাহরণ বলা হয়। সে বিচারে, বাংলাদেশ অন্তত মিয়ানমারের তুলনায় যথেষ্ট এগিয়ে। মিয়ানমারে একজন নোবেল বিজয়ী কোনমতে পুতুলের মতো বসে আছেন বিশ্ব দরবারের সামনে সং সেজে। তবে বাংলাদেশে সমস্যা হলো, গণতন্ত্র থাকুক বা নাই থাকুক, বা যতটুকুই থাকুক, ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের কাছে সব ম্লান হয়ে যায়। অন্যদিকে, মিয়ানমার কি তার জাতীয় স্বার্থের কাছে দলীয় বা ব্যক্তি স্বার্থকে বড় কিংবা ছোট করে দেখে? কীভাবে দেখে?
তাহলে আগামীতে ঘটনা কি দাঁড়াবে? কতগুলো প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরে সামনে আসছে —
১. রোহিঙ্গা সংকট কাটাতে কি বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা আগামীতেও থাকছে? যদি না থাকে, তাহলে কীভাবে অন্তত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফেরার জন্য এবং নিজ দেশে সম্মানের সঙ্গে নাগরিকত্ব পাবার লড়াইয়ে তাদের অংশ কে হবে? কারণ, এটি সত্য যে, আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবেই হোক, কোন না কোনভাবে রোহিঙ্গাদের খেতে-পরতে দিচ্ছে। যদিও খাদ্যদ্রব্য থেকে সবকিছুরই দাম বাড়ছে। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে বহুবার। তবুও কোনো না কোনোভাবে মানুষ খেয়ে-পরে আছে। যার কৃতিত্ব কোন না কোনোভাবে সরকারের ওপর যায়, কিংবা সরকার এটাকে তাদের সফলতা বলে দাবি করে। কিন্তু ক্ষমতার পালা বদলে বিএনপি কি সেটি পারবে? বিগত দীর্ঘ সময় সরকারে না থাকায় এই মেকানিজমে তারা কীভাবে অংশ হবে? এমন কি স্বঘোষিত বিরোধী দল হিসেবেও কি তারা কোনো রূপরেখা দিয়েছে? তাদের দলের স্থায়ী সদস্যদের তালিকায় একাধিক পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক জ্ঞানসমৃদ্ধ লোক আছেন। দলটির কাছ থেকে দেশবাসী কোনো সুরাহার উপায় শোনেনি, জানেনি। কিন্তু শরণার্থী-বিষয়ক পরিষ্কার জ্ঞান রাখেন, এমন কেউ কোনো দলে কি আছেন? জানি না।
একটি ভিন্ন প্রশ্ন, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের কি তাদের রাজনৈতিক ইশতেহারে অভিবাসী কিংবা শরণার্থী-বিষয়ক কোনো বক্তব্য আছে? যদি না থাকে, তবে দলগুলোর এখনই এটিতে মনযোগী হওয়া উচিত বলে মনে করি।
২. কোনো কারণে, যদি সত্যি আওয়ামী লীগের রাষ্ট্র পরিচালনার ধারাবাহিকতায় ভাটা পড়ে, তাহলে কি হবে? প্রথমত, দেখা যাবে ‘নাইটপার্টি’ নামে পরিচিত দলটি প্রথমেই মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার সমঝোতাটিকে পরিবর্ধণ কিংবা পরিমার্জনের চেষ্টা করবে। খুব সহজ কারণ হলো, ‘আগেরটি আওয়ামী লীগ করেছে, এখন আমাকে এটি পরিবর্তন করতেই হবে’ — এমন মনোভাব। নিজেকে বড় ও অন্যকে ছোট দেখানো, বাংলাদেশে রাজনীতিতে বহুল ব্যবহৃত একটি কৌশল। যদিও অতীতে বিএনপির সময়ই রোহিঙ্গারা ফেরত গেছে, কিন্তু সমস্যাটির টেকসই কোনো সমাধান হয়নি। হলে, এখন এত লোক আসত না। ফলে তখনকার কাজের সফলতা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রশ্ন তোলাটা কোনো না কোনোভাবে যৌক্তিক। কিন্তু, বিএনপি যদি মনে করে, যে উপায়ে সব হয়েছে তা ভুল। তবে কি হবে? লেজে-গোবরে হবে সব।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো দলই দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করে না। যদিও বর্তমান সরকার তথা আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো, ২০৪১ সাল পর্যন্ত তাদের নানামুখী পরিকল্পনার কথা বলছে। এটি একটি গুণগত পরিবর্তন বলা যায়।
৩. মিয়ানমার যেভাবে চেয়েছে, আমরা কি সেভাবে রোহিঙ্গাদের শণাক্ত করেছি? নাকি, আমাদের মনমতো করছি? কোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছি কি আমরা? জাতিসংঘ বা UNHCR-এর সঙ্গে জড়িত আছে কি?
যতটুকু জানা গেছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের শনাক্তকরণের কাজটি করেছে ডিপিআইকে দিয়ে। তাতে একটি ভালো সুরক্ষা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের এই ভেরিফিকেশনের কারণে কেউই ভুল তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট বানাতে পারবে না। কিন্তু, তার আগে যারা বাংলাদেশি হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এ দেশ ছেড়েছে, তাদের কি হবে? ওই দুষ্ট মানুষগুলোকে কীভাবে ফেরত আনা হবে? যারা বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে ভিনদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু আসলে তারা রোহিঙ্গা, তার কি হবে? কথাটি বলছি এ কারণেই যে, এমনটি অনেকেই করেছে। বিশেষ করে, ইউরোপে এমন মিথ্যে পরিচয়ে সেখানকার সুবিধা নিচ্ছে, খুঁজলে এমন অনেক মানুষ মিলবে। আর, কোনো দেশের নাগরিক অন্যদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতেই পারে। কিন্তু, তাতে একজন ছোট হয়, অন্যজন বড়।
প্রশ্নে আসি। বর্তমানে বাংলাদেশের তথ্য ভাণ্ডারে নাম, ছবি, পিতার নাম, মাতার নাম, জন্ম তারিখ, লিঙ্গ, মিয়ানমারের ঠিকানা ও বাংলাদেশে কখন এসে পৌঁছেছে এ তথ্যগুলো রাখা হচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশকে জানিয়েছিলো যে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করতে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে যে তথ্যগুলো রাখা হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। সেই সঙ্গে আরো বলা হয়, আলাদাভাবে তথ্য রাখতে হবে, কোন প্রেক্ষাপটে তারা বাংলাদেশে এসেছে। ইউএনএইচসিআর এর গাইডলাইন যদি ধরা হয়, তবে শরণার্থী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার তথ্যে তিন ধরনের উপকরণ রয়েছে। প্রথমত, এখনই তাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য রাখা। কী কারণে, কোথা থেকে, কোন প্রেক্ষাপটে তারা পালিয়ে এসেছে এবং তাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটের পূর্ণাঙ্গ তথ্য রাখতে হবে। দ্বিতীয় উপরকরণটি হচ্ছে, তাদের পরিবারের শাখা-প্রশাখা। এর মাধ্যমে কোনো রোহিঙ্গার আদি ইতিহাস এবং সহজেই তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের শণাক্ত করা সম্ভব। আর তৃতীয় উপকরণটি হচ্ছে, মিয়ানমারের বাসস্থানের পূর্ণাঙ্গ তথ্য। সেই সঙ্গে পালিয়ে আসার সময়ে কার বাচ্চা হারিয়ে গেছে বা কার স্ত্রী অপহৃত হয়েছে এ ধরনের তথ্যগুলোও থাকলে তাদের ফেরত পাঠানো সহজ ও দ্রুততর হবে।
ফলে প্রথম থেকে যদি কাজটি করা হতো, তাহলে এক কষ্ট দুইবার করতে অর্থ, লোকবল, বা সময় অপচয় হতো না। যদিও ওই মুহূর্তে তাড়াহুড়োতে অনেক কিছু করতে হয়েছে। তবে এক ধাক্কায় সবগুলোর একটি হিসাব করা হয়েছে এখন, যেটি আগামীতে কাজ লাগবে।
৪. যেসব রোহিঙ্গা গত বছরের আগে এসেছে, তাদের কী হবে? তারা কি আর কোনোদিন ফিরতে পারবে না? মিয়ানমার এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কৌশলী ভূমিকা দেখিয়েছে নিঃসন্দেহে। কীভাবে? গত বছরের শেষদিকে অর্থাৎ ২৫ আগস্টের পর থেকে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলছে তারা। কিন্তু এর আগে আসা রোহিঙ্গাদের কথা বলছে না মিয়ানমার। তাদের কী হবে? কবে যাবে তারা? কীভাবে যাবে? বিষয়টি নিয়ে তারা মুখ খুলছে না। বর্তমান সরকার সেটিকে মাথায় রেখেছে কি?
৫. মিয়ানমার কি কোথাও লিখিত দিয়েছে যে, যেসব রোহিঙ্গা যাবে, কিংবা যারা আছে সেদেশে এখনো, তারা আর কেউ কোনদিন প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসবে না? যদি এমনটি না লিখিত দিয়ে থাকে, আমরা কি সেটি নেওয়ার চেষ্টা করেছি কিংবা করা উচিত কি না? কারণ, এই মানুষগুলো কতদিন ধরে এমন যাওয়া-আসার মধ্যে থাকবে?
এ বিষয়টি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য যা যা করেছে, তা মিয়ানমার কখনো করেনি।
লেখক : একজন পররাষ্ট্রবিষয়ক সংবাদকর্মী