ভালোবাসার দিন
জীবনের জন্য ভালোবাসা
ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস বাঙালির আটপৌরে জীবনে ভীষণরকম বাঙ্ময় ও আলাদা। আলসে শীতের দোটানা মন ঋতুরাজ বসন্তে পা দিয়েই ভালোবাসার ডালি সাজায়। একে তো ফাগুন, তার ওপর আবার ভালোবাসা—মানবীয় বাসনায় এ যে সোনায় সোহাগা। প্রেমের কবিরা বলেন, ভালোবাসা থাকলে সব হয়। আর আমরা বলি, ভালোবাসার দায়দায়িত্ব সবচেয়ে বড়। আধুনিক বিজ্ঞাপনের এন্ডিং লাইন ‘ভালোবাসলে যত্ন করতে হয়’—এটি মিথ্যা নয়। আজ ভালোবাসা দিবসে সবার সবার প্রতি না হয় একটু বেশিই যত্ন নেওয়া যাক। রাবীন্দ্রিক ভাষায় বলতে হয়, তাহার তৃষ্ণা আপনার সুধা আর তাহার তৃপ্তিই আপনার সুধা। যে জীবন এত আনন্দময়, সেই জীবনের জন্যই তো এমন অমৃত ভালোবাসা।
বাংলাদেশে ঘটা করে ভালোবাসা দিবস পালনের সময়টা খুব বেশি দিনের নয়। তবে যখন থেকে এই রীতি শুরু হয়েছে, তখন থেকেই খানিকটা ভালোবাসার জন্য বাঙালির কাঙালপনা চোখে দেখবার মতো। যার যেটার অভাব সে সেটা পৃথিবী ঘুরে হলেও খুঁজবে, এটা অতি স্বাভাবিক। আমাদের চারপাশে এতশত ঘৃণা নিয়ে আমরা দিন গুজরান করি যে ভালোবাসবার ফুরসত পাই না। তাই তো ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নামে একটি দিন আমরা উজাড় করে ভালোবাসা দেখাই। হোক না তা লোক দেখানো! বেঁধে দেওয়া ২৪ ঘণ্টার তাড়াহুড়োয় আমরা যে কী করতে কী করি দিশা পাই না। ফুল কেনা, কার্ড কেনা, চকলেট পছন্দ করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভার্চুয়াল চিঠি চালাচালি করতে করতে দোকানদার অথবা নেট প্রোভাইডারের পকেট ভরানো চলতে থাকে।
কিন্তু এভাবে এমন একদিনের ভালোবাসা নিয়ে হাজার বছর পৃথিবীর পথ হাঁটলেও কি জীবনের দিশা পাওয়া যাবে? অথচ আমরা চাইলেই সকল দুঃখ-ক্লেশ একপাশে রেখে প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধকে আনন্দধারায় ভাসিয়ে দিয়ে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে অহর্নিশ অতল রোদনে দুলে উঠতে পারি। আর প্রেমের শরাব পিয়ে আমাদের অতি আরাধ্য ভ্যালেনটাইন প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের মতো করে সোহাগমথিত কণ্ঠে বলতে পারে, এত দিন কোথায় ছিলেন? আর আমরা হাল ভেঙে দিশা হারানো নাবিকও হয়ে উঠতেই পারি।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়োভস্কি বলতেন, তোমার হৃদয়ের যতটা আমাকে দিতে পার তার বেশি তো আমি চাইতে পারি না! ভালোবাসা চাইবার মধ্যে একধরনের পরিমিতিবোধ থাকতে হয়। কিন্তু বাঙালির চাওয়া-পাওয়ার রকম-সকম এমন নয়। আমাদের এখানে প্রেমিক-প্রেমিকাকে অথবা বিপরীতে প্রেমিকাকে-প্রেমিক যদি ভালোবাসার অতল সাগর কিংবা এভারেস্ট পর্বতও দিয়ে ফেলে, তাও মন ভরবে না। দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমনটা বলে রেখেছেন, ভালোবাসার কোনো অর্থ বা পরিমাণ নেই। অন্যদিকে কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার নারী ও পুরুষের ভালোবাসাকে গুলিয়ে ফেলে পিতৃতান্ত্রিকতার জয়গান করেছেন, ছেলেরা ভালোবাসার অভিনয় করতে করতে যে কখন সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেলে তারা তা নিজেও জানে না। আর মেয়েরা সত্যিকার ভালোবাসতে বাসতে যে কখন অভিনয় শুরু করে, তারা তা নিজেও জানে না। বিপরীতটাও যে হতে পারে লেখক তা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় হয়তো পাননি। তার চেয়ে বরং ইংরেজ কবি জন মিলটনের কথাই শিরোধার্য, জীবনকে ঘৃণা কোরো না জীবন কে ভালোবাসতে শেখো। ভালোবাসা দিয়ে এবং ভালোবাসা পেয়ে তোমার ক্ষণিক জীবন স্বর্গীয় সুষমায় উদ্ভাসিত করে তোল।
আমাদের এতদাঞ্চলে বিয়েপূর্ব, বিয়েহীন কিংবা বিবাহিত ভালোবাসা নিয়ে বিস্তর গবেষণা রয়েছে। এ বিষয়ে প্রচুর ফিকশন রচনাসমগ্রও আছে। রাজধানীতে ঘটা করে ফি বছরের মতো এবারও বইমেলা চলছে। প্রেমবিষয়ক উপন্যাস, গল্পসমগ্র বা কবিতার বইও সেখানে দেদার প্রকাশিত হচ্ছে। আজকের ভালোবাসার দিনে নিশ্চিতই প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে তাদের পছন্দের লেখকের লেখ্যকর্ম শোভা পাবে। লেখকের বইপাঠে নিজেদের মধ্যে যে আনন্দ শেয়ার করা যায়, সে ভালোবাসা নিশ্চয় লেখককেও স্পর্শ করে। লেখকও তো পাঠকের ভালোবাসার বড় কাঙাল।
অনেকেই দোটানায় থাকেন, যাকে ভালোবাসেন তাঁকেই বিয়ে করবেন? নাকি হুট করে ধরে আনা অন্য কেউ ঘরণী হয়ে বাড়ির অন্দরমহলের শোভাবর্ধন করবে? বিখ্যাত রুশ লেখক লিও তলস্তয় অবশ্য বলে রেখেছেন, একমাত্র প্রেমেই বিয়েকে পবিত্র করতে পারে। আর একমাত্র অকৃত্রিম বিয়ে হচ্ছে সেটাই, যেটা প্রেমের দ্বারা পবিত্রকৃত। কিন্তু আমাদের কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেন অন্যকথা, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ে না হওয়াটাই বোধ হয় ভালো। বিয়ে হলে মানুষটা থাকে ভালোবাসা থাকে না। আর যদি বিয়ে না হয়, তাহলে হয়তো বা ভালোবাসাটা থাকে, শুধু মানুষটাই থাকে না। মানুষ এবং ভালোবাসা এই দুয়ের মধ্যে ভালোবাসাই হয়ত বেশি প্রিয়।
আজকে থেকে তবে ভাবতে বসে যান, যাকে ভালোবাসতে গিয়ে সারাটা দিন তার জন্য ব্যয় করলেন ভবিষ্যতে তাকে বিয়ে করে মানুষটাকে হারাবেন নাকি প্রেমের দ্বারা পবিত্র করে আপনাদের বিয়েটাকে অকৃত্রিম অভিধায় পর্যবসিত করবেন? তবে আপনি যেটাই করুন, যুদ্ধাহত সেনাদের ভালোবেসে চিকিৎসা করা অথবা মতান্তরে নিজের দয়িতাকে ভালোবাসবার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ভালোবাসা দিবসের উদ্গাতা রোমান খ্রিস্টান পাদ্রি অথবা চিকিৎসক ফাদার সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন নিশ্চয় আশীর্বাদ করতে ভুল করবেন না।
ভালোবাসা দিবসটিকে ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি পালন করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর কিংবা বইমেলা চত্বরে থাকবে বেপরোয়া প্রেমিকযুগলদের আনাগোনা। রঙিন পোশাকের সঙ্গে নারীদের মাথায় থাকবে পুষ্পসাজ। কারো গালে আঁকা থাকবে রংতুলির আলপনা। তারা একসঙ্গে গান গাইবে, নাচবে, ভালোবাসার চিঠি পাঠ করবে এবং উপস্থাপন করবে ভালোবাসার দাবিনামা।
কিন্তু একবারের জন্য যদি সব ঘৃণা-সব অনাচার শিকেয় তুলে মানুষকে ভালোবাসতে বাসতে জনে জনে দেশটারেও মন দিয়ে ভালোবাসতে পারতাম তবে কী সুন্দর জীবনই না হতো আমাদের! এই একদিন আমরা বর্ণাঢ্য উৎসব করতে পারি ‘লাভ ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামে। একদিনের জন্যও যদি ভালোবাসার আলো দিয়ে মায়ের মতো প্রাণের এই দেশটার আঁধার দূর করে দিতে পারি তাও বা কম কিসে? এই প্রতীতি আমাদের সবার হোক, ভালোবাসায় আগলে রাখব মানুষ আর দেশটারে। তবেই সকল ‘অচলায়তন’ ভেঙে দিয়ে একদিন আমরাও বুকের ঘরে অসীম আনন্দ নিয়ে বাংলার মাটিকে জড়িয়ে ধরে গলায় তুলতে পারব রাবীন্দ্রিক সুর :
আজ যেমন করে গাইছে আকাশ
তেমন করে গাও গো।
যেমন করে চাইছে আকাশ
তেমনি করে চাও গো।
আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায়
মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়,
তেমনি আমার বুকের মাঝে
কাঁদিয়া কাঁদাও গো।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।