অভিমত
প্রশ্নপত্র ফাঁসের শেষ কোথায়?
এ বছর এসএসসি পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিনেই প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেই ঘোষণার কোনো ফলই পাওয়া যায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব হুঁশিয়ারিকে চ্যালেঞ্জ করে প্রশ্ন ফাঁসকারীরা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন বিক্রি করেছে। অবশ্য বছর বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা বেমালুম অস্বীকার করে গেলেও এ বছর এ ব্যাপকতায় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে মন্ত্রণালয়। এ জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
কুচক্রী মহল তো তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেই। আগে থেকেই ইঙ্গিত ছিল মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর কাছে। তাহলে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো? দু-একটি নয়, বলতে গেলে প্রতিটিতে পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মাধ্যমে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ নাম না প্রকাশের শর্তে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা না পাওয়ার। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নসহ শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করছে। কিন্তু এসবে মূল হোতারা কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? না বরাবরের মতো তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে?
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সময় সীমিত সময়ের জন্য ফেসবুক-টুইটারসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত, যুক্তিও ছিল। কারণ, কারো কারো অনিয়মের দায় কেন সবাই ভোগ করবে? পরে অবশ্য দোষ চাপে শিক্ষাপদ্ধতির ওপর। শিক্ষা সচিব বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতে প্রশ্ন ফাঁস রোধ সম্ভব নয়।
শুধু এই এসএসসি কেন, প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ব্যাংক, এমনকি বিসিএসের মতো পরীক্ষায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রতিযোগিতামূলক এসব পরীক্ষার ফাঁসের অভিযোগ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু তাতে কী লাভ? আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের অবশ্য ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগের রেওয়াজ নেই; বরং শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তিনি যখন ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তখনও প্রশ্ন ফাঁস হতো। ফলে ধরে নিতে হয়, এটা আমাদের ঐতিহ্য বা রেওয়াজ।
প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ে সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যে কথা বললেন, এরপর আর এ নিয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক কিংবা সমালোচনা সাজে না। আপাতদৃষ্টিতে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী হয়তো সফল। তাঁর নেতৃত্বে শিক্ষায় অনেক যুগান্তকারী কাজও হয়েছে হয়তো। প্রায় শতভাগ শিশু প্রাথমিকে ভর্তি হচ্ছে, প্রতিবছর সব স্কুলে ছাত্রকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করা হচ্ছে, যা বছর বছর বাড়তে বাড়তে এ বছর ৩৬ কোটি বইয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর জন্য তিনি অবশ্য সাধুবাদ পেয়েছেন। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মানসম্পন্ন শিক্ষার শর্ত পূরণ আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে নাকি?
এবার আসি নীতি-নৈতিকতার কথায়। এই প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে একটি চক্র। আর তা কয়েকটি হাত ঘুরে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে যাচ্ছে। এই ছাত্ররা প্রশ্ন পাওয়ার আগে হয় তার অভিভাবক অথবা শিক্ষককের হাতে যাচ্ছে অথবা তারা এ বিষয়ে আগেই জানতে পারছে। যে শিক্ষক তার ছাত্রকে এই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন, তাঁরা কি মানুষ গড়ার কারিগর, না চুরিবিদ্যা শেখানোর কারিগর? আর যেসব অভিভাবক সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন, তাঁরা?
কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে জিহাদ চলছে অনেক দিন ধরেই। এবার পরীক্ষার আগেই এসব কোচিং সেন্টার বন্ধের নির্দেশ ছিল সরকারের। কতটা তা মানা হয়েছে বা হয়নি, এ নিয়ে অবশ্য কোনো জরিপ আমার জানা নেই। কোচিং সেন্টার বন্ধের ঘোষণায়ও যে কোনো লাভ হয়নি, তা বলা বাহুল্য।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড—এই আপ্তবাক্য বহু ব্যবহারে জীর্ণ এবং হয়তো তাই অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু উক্তি অকারণে তৈরি হয় না। মেরুদণ্ড নিয়ে যেভাবে টানাটানি শুরু হয়েছে, তা জাতির ভবিষ্যতের সত্যিই উদ্বেগের। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মন্তব্য এখানে প্রসঙ্গক্রমে তুলে ধরতে চাই। তাঁর মতে, এত পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। এমসিকিউ একেবারে কমিয়ে দিতে হবে। কোচিং বন্ধ করে দিতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করতে শূন্য সহনশীলতা দেখাতে হবে।
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় কমিটি ও অধ্যাপক কায়কোবাদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রশাসনিক কমিটি গঠন করেন হাইকোর্ট।
আমরা আশা রাখতে চাই, শুধু সময়ক্ষেপণ কিংবা পরিস্থিতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য যেন না হয় এই তদন্ত কমিটি। তারা সত্যিকার অর্থেই মূল হোতাদের খুঁজে বের করবেন।
২ মার্চ থেকে শুরু হবে এইচএসসি পরীক্ষা। দয়া করে আমাদের কর্তৃপক্ষ এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কিংবা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাওয়ার অপেক্ষায় রাখবেন না। গণমাধ্যমে বক্তৃতা-বিবৃতি নয়, সত্যিকার অর্থেই প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানোর পদক্ষেপ নিন।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।