ক্রিকেট
‘না’র মাঝেও মাশরাফির স্বস্তির নিশ্বাস
চাইলে তিনি ফিরতে পারতেন। ক্রিকেটের ছোট্ট সংস্করণে ফেরার অনুরোধও তাঁকে করা হয়নি, তাও নয়। কিন্তু তিনি ছোট্ট একটা অক্ষরে জবাব দিয়ে দিলেন—‘না’। একটু বড় করে লিখলে লিখতে হচ্ছে—না, মাশারফি আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ফিরছেন না।
ম্যাশের এই ‘না’ তাঁর অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর মন খারাপের অনুষঙ্গ হতে পারে। টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফির হঠাৎ অবসরে অনেকে চমকে উঠেছিলেন। অনেকের মন খারাপ হয়েছিল। বছরখানেক আগে কলম্বোতে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচে টস করতে নেমে হুট করে অবসরের ঘোষণা! টিভি মাইক্রোফোনের সামনে মাশরাফিকে দেখে এবং তাঁর কথা শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, লোকটা একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন! উল্টো মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ডেথ সার্টিফিকেট! সেটা কি স্বাভাবিক মৃত্যুর! নাকি আত্মহত্যা! শেষটাকে বেশি বিবেচ্য মনে হচ্ছিল।
অবসর মানে তো নিজের ক্যারিয়ারের ওপর দাড়ি টেনে দেওয়া। মাশরাফি কেন, ক্রিকেটের সব ফরম্যাট থেকেই সব ক্রিকেটারকে একসময় সরে যেতে হয়। তবে মাশরাফির সরে যাওয়ার পেছনে পারিপার্শ্বিক কোনো চাপ ছিল না কি না, সেই রহস্য এখনো অনুন্মোচিত। মাশরাফির নিজের লেখা আত্মজীবনীতে হয়তো দু-এক লাইন থাকলেও থাকতে পারে। তবে এখনো মনে হয়, সেদিন মাশরাফির টি-টোয়েন্টি থেকে সরে দাঁড়ানো পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নেওয়া। আর এই মুক্তির পথ খুঁজতে তাঁকে প্ররোচিতই করা হয়েছিল। শেষ বাক্যটা অনেকের কাছে খটকা লাগতে পারে! মাশরাফির মতো ক্রিকেটারকে প্ররোচিত বা প্রভাবিত করার মতো লোক কোথায় বাংলাদেশ ক্রিকেটে! তা ছাড়া তাঁর নিজের মুখনিঃসৃত বক্তব্য ছাড়া ও রকম প্ররোচিত করার কথা লেখা কি ঠিক?
পেশাদারিত্বের নিক্তি দিয়ে মাপতে গেলে কথাগুলো লেখা হয়তো ঠিক দাবি করা যাবে না। কিন্তু সাংবাদিক সেও মানুষ। যন্ত্র নয়। তারও মন, বুদ্ধি, হৃদয়, আবেগ বলে কিছু জিনিস আছে। তা ছাড়া চোখ দিয়ে দেখা আর কান দিয়ে শোনা শব্দগুলো ল্যাপটপে কম্পোজ করে পাঠকের কাছে তুলে ধরার মধ্যেই সাংবাদিকতার সীমারেখা আটকে রাখার দিন শেষ।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে মাশরাফির অবসর বাংলাদেশ ক্রিকেটে বড় এক ঝাঁকুনি ছিল। সেই ঝাঁকুনি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি থেকে অনেক কর্মকর্তাই মাশরাফিকে ফেরানোর উদ্যোগের কথা বলেছেন। বিশেষ করে যে শ্রীলঙ্কায় নিজের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটীয় সত্তার মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন, সেখানেই আবার ত্রিদেশীয় সিরিজে তাঁর পুনঃজন্ম হোক টি-টোয়েন্টিতে, তেমনটাই চেয়েছিলেন বিসিবি কর্তারা। কিন্তু সেই উদ্যোগে পানি ঢেলে দিলেন মাশরাফি নিজেই। এবং সেটা ছোট একটা শব্দে—না।
এই ‘না’ বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাস এবং মাশরাফির জন্য বাড়তি একটা অধ্যয় না হোক, একটা অনুচ্ছেদ হয়ে থাকবে। এই দেশ, এই সমাজে কেউ নিজের জায়গা ছাড়তে চান না। আবার ফেরার ডাক পেলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস ক’জনে দেখাতে পারেন। মাশরাফি পারলেন। বোলার মাশরাফি, ক্রিকেটার মাশরাফির চেয়ে সামাজিক প্রভাবে অধিনায়ক মাশরাফি অনেক এগিয়ে থাকবেন। নিম্নবিত্ত একটা ক্রিকেট দলের মধ্যবিত্ত এক অধিনায়ক মাশরাফি। কিন্তু মানসিকতা দিয়ে, মানুষ হিসেবে নিজের রুচি এবং মর্যাদাবোধ দিয়ে নিজেকে জনমানসে অন্য রকম একটা বেদিতে বসাতে পেরেছেন। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পেরেছেন। নিজের অর্জিত সেই জায়গাটা আরব সাগরের পাড়ে কলম্বোতে বিসর্জন দিতে যাওয়ার মধ্যে অন্যরকম তৃপ্তি বা স্বস্তির কী আর থাকতে পারে! সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি মাশরাফির। তাই আবার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ফেরার ডাকে ছোট্ট করে ‘না’।
‘হ্যাঁ, অবসর ভেঙে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার নজির বিরল নয়। অনেক আছে। কিন্তু একমাত্র ইমরান খান ছাড়া ক্রিকেট ইতিহাস কজনকে মনে রেখেছে। পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ককে মনে রেখেছে, কারণ অবসর ভেঙে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে পাকিস্তানকে বিশ্বকাপটা এনে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ইমরান খানও আবার মাঠ থেকে বলেকয়ে বিদায় নিতে পারেননি। সেই আক্ষেপ-যন্ত্রণা তাঁকেও পোড়ায়নি, তা নয়। মাশরাফি অন্তত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে মাঠে দাঁড়িয়ে বিদায় বলতে পেরেছেন।
অবসরোত্তর জীবনে নিশ্চিন্তে নিশ্বাস ফেলার জায়গা তো তাঁর থাকল। আর ফেরার ডাকে ‘না’ বলে দিয়ে সেই জায়গাটা আরো বড় করে নিলেন।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট।