কোটা বিতর্ক
কোটাধারীরা আরো কত দিন পেনাল্টিতে গোল দেবে?
আমাদের দেশে বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে কোটা অনেকটা এ রকম—৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ৫ শতাংশ উপজাতি, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা আর ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সব মিলিয়ে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটাব্যবস্থা চালু রয়েছে। তার মানে ৪৪ শতাংশ মেধার জোরে আর বাকি সবাই সরকারি চাকরিতে ঢুকছে কোটার জোরে। তবে বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে মেধার চেয়ে কোটার জোর এত বেশি আছে বলে আমার জানা নেই।
অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা চালু রয়েছে। ১৯৭২ সালের ৫ নভেম্বর এক নির্বাহী আদেশে সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি এবং জাতীয়করণ প্রতিষ্ঠানে জেলা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৩০ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১০ ভাগসহ ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য কোটা প্রবর্তন করা হয়। পরে বিভিন্ন সময় এ কোটাপ্রথা সংস্কার ও পরিবর্তন করে বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি নিয়োগে মোট ৫৬ শতাংশ কোটাব্যবস্থা চালু রাখা রয়েছে।
কোটাব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রশাসনে মারাত্মক গোলযোগের সৃষ্টি হয়েছে। যোগ্য প্রার্থীর অভাবে অনেক পদ বহুদিন ধরে খালি পড়ে আছে। এভাবে খালি পড়ে থাকা অথবা অযোগ্যদের দিয়ে শূন্যস্থান পূরণের ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাষ্ট্র আপনাআপনিই অকার্যকর হয়ে পড়বে।
বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। প্রতিবছর অন্তত ১০ লাখ মেধাবী ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজ থেকে বের হচ্ছে। তারা বিরাট মানবসম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারছে না রাষ্ট্র। আমাদের দেশের চাকরির ক্ষেত্রটি এভাবে তুলনা করা যায় যে, এই ক্ষেত্র এমন এক ফুটবল মাঠের মতো পরিণত হয়েছে। যেখানে কোটাধারীরা পেনাল্টিতে গোল দিচ্ছে আর প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে গোলে কিক নেওয়ার আগেই কোটাধারীদের আক্রমণে পরাস্ত হচ্ছে।
কোটাপদ্ধতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, যাদের জন্য কোটা দরকার, তারা না পেয়ে পাচ্ছে অন্যরা। এ কোটাপদ্ধতি তাদের জন্য দরকার, যারা চলতে-ফিরতে পারে না। যাদের বলা হয় প্রতিবন্ধী। কিন্তু এসব মেধাবী মেধার সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অল্প কিছু সুযোগ রাখা অবশ্যই দরকার। তবে ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। কারণ, বাংলাদেশে যে হিসেবে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হিসেবে চাকরি পাওয়া খুবই দুরূহ। আর তাই কোটাপদ্ধতির হার কমিয়ে সব শিক্ষার্থীকে চাকরি করার সুযোগ করে দেওয়া যেকোনো সরকারের আবশ্যিক কর্তব্য।
পিএসসির তথ্যানুযায়ী, প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে গড়ে ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেন তাঁরা। কিন্তু চলতি বছরের হিসাবে এবারে ৩৮তম বিসিএসে অংশ নেন সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থী। কোটাপদ্ধতির কারণে কেউ যদি সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন, তাহলে তিনি চাকরি নাও পেতে পারেন। কারণ ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে দেওয়া যাবে। কাজেই ২২৬তম হয়ে তিনি চাকরি পাবেন না। আবার কোটা থাকলে কেউ সাত হাজারতম হয়েও চাকরি পেতে পারেন।
আর সবচেয়ে বড় সংকট কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে ওই পদগুলো শূন্য রাখতে হয়। ফলে একদিকে যেমন মেধাবীরা নিয়োগ পায় না, অন্যদিকে হাজার হাজার পদ শূন্য থাকে। বিগত কয়েকটি বিসিএসের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া যাওয়ায় ২৮ থেকে ৩৫তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে পাঁচ হাজার পদ খালি থেকে গেছে।
যার ফলে মেধাবীরা উত্তীর্ণ হয়েও একদিকে চাকরি পাচ্ছে না, অন্যদিকে শত শত পদ শূন্য রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও কৃষি কর্মকর্তাদের মতো কারিগরি ক্যাডারের প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন।
তবে শুধু বিসিএস নয়, গত বছর নয় হাজার ৬০৯ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ করা হয়। এসব পদের মধ্যে দুই হাজার ৮৮২টি পদ মুক্তিযোদ্ধার কোটাভুক্ত ছিল। কিন্তু এর জন্য প্রার্থী পাওয়া গেছে মাত্র ১০১ জন। কোটার প্রার্থী না পাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার পদ শূন্য থাকছে। অথচ লাখ লাখ ছেলেমেয়ে একটা চাকরি পাচ্ছে না। সবাই আমরা কোটাব্যবস্থার বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। কিন্তু আর কতকাল চলবে এই বৈষম্য?
তাই কোটা নামের যে কাঁটা নাগরিকের সমঅধিকার কেড়ে নিয়েছে, তা আর মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এই কাঁটা সহ্য করার ক্ষমতা আমরা তরুণরা আজ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা এই কাঁটা থেকে মুক্তি চাই। খুব দ্রুতই কোটা সংস্কারের উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে, কীভাবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়।
এ দেশ আমাদের সবার। এখানে কোনো বিভাজন কাম্য নয়। আর দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে মেধাবীদের স্থান পাওয়াটা খুবই জরুরি। কোটার ফাঁদে পড়ে মেধাবীরা যেন চাকরি বঞ্চিত না হয় এবং অমেধাবীরা যেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢুকে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।