অভিমত
ন্যায্যতা কোটায় নাকি মেধায়?
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিপ্রত্যাশীদের বেশিরভাগ অংশেরই বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি নিয়ে আপত্তি রয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময়েই চাকরির পরীক্ষার ফলাফলে কোটা অনুসরণে মেধাবীরা বঞ্চিত হওয়ায় অনেক প্রার্থী রাস্তায় আন্দোলন-অবরোধ করে। ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে কোটা অনুসরণ করে ফল প্রকাশ করায় মেধাবীরা বঞ্চিত হওয়ায় তাঁদের (বঞ্চিতদের) আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) ওই ফল বাতিল করে সংশোধিত ফল প্রকাশে বাধ্য হয়েছিল। বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে কোটা চালু হলেও এখন এই কোটাই প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আবার বিভিন্ন সময় বিশেষ ধরনের কোটায় বিশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। দুঃখের বিষয় হলো, বিসিএস ও ব্যাংকের নিয়মিত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোটার প্রয়োগ করার পাশাপাশি বিশেষ কোটায় পৃথক নিয়োগের ব্যবস্থাও করা হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পোষ্যকোটা, আনসার কোটাসহ সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক নানাবিধ ও নানামাত্রিক কোটা বিভিন্ন চাকরিতে অনুসরণ করা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই মেধাবীদের বঞ্চিত করে। বিষয়টিকে নিঃসন্দেহে কোটার ভেতরে কোটা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
৫৬ শতাংশ কোটা অনুসরণ সংবিধানসম্মত কি না, তা যাচাই করার মাধ্যমেও কোটা সংস্কারের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ২৮(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ ২৮(২)-এ আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’
অন্যদিকে সংবিধানের ২৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ ২৯(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রদর্শন করা যাইবে না।’ ২৯(৩)(ক) তে বলা আছে, ‘নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’
সংবিধানের ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতা সম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন অইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে।’ এ ছাড়া ২০(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়’ এবং ‘প্রত্যেকের নিকট হতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী—এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবে’। ২১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।’ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা সংবিধানের ১৪৮(২)ক অনুচ্ছেদ মতে, পদের শপথ (বা ঘোষণা) গ্রহণ করে থাকেন। সেখানে শপথের সময় বলা হয়— ‘আমি সংবিধান রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করব এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করব।’ কিন্তু কার্যত কী হচ্ছে, সেটি ভাববার বিষয়।
সংবিধানের উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই কোটাপ্রথা সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নাগরিকদের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও চাকরি ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি আমাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরকারি চাকরিতে যে কোটা অনুসরণ করা হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানের এই বর্ণিত ধারণাগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কোটাপদ্ধতির কারণে নাগরিকের সাংবিধানিক এ অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না। সংবিধানে সমতা ও বৈষম্য দূরীকরণের কথা থাকলেও কোটার নামে বৈষম্য চলমান রাখা হয়েছে। সংবিধান সর্বদা আইনের সমতার কথা বলে। আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান অধিকারভোগী। সংবিধান সরকারি চাকরিতে সুযোগের সমান অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে বলে থাকে।
সরকারি চাকরিতে কোটা প্রক্রিয়াটি কখনো সরল-সোজা ছিল না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই জটিলতা সৃষ্টি করে। ক্ষেত্রবিশেষে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হয়। তাই কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সংস্কার জরুরি। বিদ্যমান আনুপাতিক হার কমিয়ে যৌক্তিক অবস্থায় আনার কোনো বিকল্প নেই। সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের প্রাধান্য দিতে হবে, তবে সে ক্ষেত্রে থাকতে হবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। তা না হলে সাধারণের বিপরীতে বিশেষ ব্যবস্থার আধিক্য জটিলতাই সৃষ্টি করবে কিন্তু কোনো কল্যাণকর কিছু হবে না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ।