ইয়েশিম ইকবালের ব্লগ
আমরা কোথাও যাচ্ছি না
গত চার মার্চ জনপ্রিয় লেখক, শিক্ষাবিদ ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাত করে ফয়জুর নামের এক যুবক। জখম জাফর ইকবালকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট থেকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আনা হয়। জাফর ইকবালের ওপর এ হামলার ঘটনায় দেশজুড়ে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে নিন্দা জানিয়েছেন এই হামলার। গত ছয় মার্চ ‘রেসপন্স টু দ্য অ্যাটাক অন মাই ফাদার’ শিরোনামে নিজস্ব ব্লগে নিজের বাবার ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাফর ইকবালের একমাত্র কন্যা ইয়েশিম ইকবাল। ইংরেজীতে লেখা সেই ব্লগের বাংলা অনুবাদ করেছেন মেহেদী নোভেল।
আমরা সবাই অবশ্যই বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন। যারা এই লেখাটা পড়ছেন তাদের অনেকের মত আমিও গভীর অস্বস্তি এবং দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি আমাদের দেশটা আর নিরাপদ না। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আমি বড় হয়ে উঠেছি সেখানে রোবটিক্সের প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে থাকা অবস্থায় আমার বাবাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। আমার একজন তরুণ বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল, “কেন ইয়েশিম আপু? এতসব হয়ে যাওয়ার পরও এখানে কেন থাকবে তোমরা?
এসব শুনে মনে হয় মানুষ দেশের পরিস্থিতি নিয়ে নিরাশ হয়ে পড়েছে। বলছে, আমার পরিবার যদি দেশ ছাড়ে, তাহলে সেটা আমার বাবারই পরাজয় হবে।
যাহোক,
আমি সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই। আসলে আমি খুব বেশি শ্রম না দিয়ে কিছু শব্দ আমার বাবার কাছ থেকে ধার করব কারণ আমি জানি সুস্থ হওয়ার পর তিনি কী বলবেন। দেখুন কোন অবস্থাতেই আশা হারানো যাবে না। যে জিনিসগুলো আপনার কাছে সুন্দর, আপনার দেশের জন্য আপনি যা মন-প্রাণ দিয়ে চান এবং যেগুলো এখনও হাতের মুঠোয় আসেনি, সেগুলো পাওয়ার আগ পর্যন্ত কখনই যুদ্ধ বন্ধ করা যাবে না।
আজ পর্যন্ত কোন কিছু সহজে আসেনি। প্রত্যেকটি জিনিস যা আপনি আজকের দিনে পৃথিবীতে উপভোগ করছেন-রাস্তায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা, খাওয়ার জন্য খাবার, অসুস্থতার সময় ডাক্তার, স্কুলে যাওয়ার অধিকার, ভোট দেওয়ার অধিকার, কাজ করার জন্য চাকরি, যা আপনাকে রিক্সায় চড়া এবং কিছু ফুচকা খাওয়ার জন্য অর্থের যোগান দেয়, যা আপনার পেটের বারোটা বাজালেও সেটা আপনার কাছে মূল্যবান কারণ কারো সঙ্গে সেটা খেতে পারা আপনার মুখে হাসি এনে দেয়-এরকম প্রতিটি আলাদা জিনিস যা আপনি উপভোগ করেন তার জন্য, যে আপনার আগে এসেছে সে যুদ্ধ করেছে। কোনকিছু কখনই বিনামূল্যে এবং সহজে আসেনি। কিছু মানুষ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র, টুকরো থেকে টুকরো, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এটার জন্য যুদ্ধ করেছে। এরা আমার বাবা-মা’র মত, হ্যাঁ, আমার আপনার মতই মানুষ। এটা আমাদের অধিকার, এটা আমাদের দায়িত্ব, যা দেয়া হয়েছে তার প্রতিটি কণা গভীরভাবে উপভোগ করব এবং এটা আআমদের দায়িত্ব যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যা আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। সম্ভবত আমাদের সন্তানেরা সেটা অর্জন করতে পারবে।
যখন পরিস্থিতি কঠিন হয়, যখন পরিস্থিতির জন্য নিতান্ত ক্ষোভে চিৎকার এবং কাঁদতে ইচ্ছে করে – আমি জানি, আমি জানি আমি আমার তরে আছি এবং আপনি পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করবেন না। আপনি গভীর, গভীর একটা নিঃশ্বাস নিন। চারপাশে দেখুন, এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনার পথে ফেলে আসা পড়া সাহসের টুকরোগুলো নিজের মধ্যে একত্রিত করুন। চিবুক উঁচু করে একগুঁয়ের মত যে আপনি পারবেন, এবং আপনি আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে খুঁজে নিন।
আমি খুব ভালো করেই জানি আমি এই কথাগুলো বলতে পারছি এই কারণে, কারণ আমার বাবা বেঁচে আছে এবং ভালো আছে, এরই মধ্যে এই সেমিস্টারে পাঁচটা কোর্স কিভাবে পড়াবেন এই নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। আমি এই মুহূর্তে সেইসব পরিবার ও বন্ধুদের কথা চিন্তা করছি যারা এই একই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেক মেয়েরা আছে যাদের বাবা আর সুস্থ হয়ে ওঠেননি। হ্যাঁ আমি আপাদের নিয়েই ভাবছি।
আমি এই দেশে থাকছি কারণ আমি এটাই পছন্দ করি। আমার কাছে এইরকম নির্মম ঘটনা ঘটার জায়গা এটা না। এসব ঘটনা এবং যারা এগুলোর জন্য দায়ী তারা একটি সমস্যা যা আমাদের মোকাবেলা জরুরী হয়ে পড়েছে। এরা টিউমার অথবা হতে পারে ফাঙ্গাস। তারা কুৎসিত, এবং এগুলো দেখা দিয়েছে কারণ এগুলো পরিষ্কার রাখতে আমরা যথেষ্ট ভালো কাজ করতে পারিনি। আমাদের এই সমস্যার মূলোৎপাটন প্রয়োজন।
এই দেশটা এই সমস্যাগুলোর জন্য না। এই দেশটা ‘কান পেতে রইয়ে’র মত সেচ্ছাসেবীদের জন্য। যাদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। এই দেশটাতে রয়েছে ছায়ানট আর শিল্পকলা একাডেমির মতো আনন্দের জায়গা, যেখানে আমি হৃদয়ের গান খুঁজে পাই। ইতিহাসের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত স্বত্ত্বেও এই ছোট দেশটা বিজ্ঞানে, শিল্পে, সাহিত্যে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে! এই দেশেই আছে একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আমি অনেক কিছু শিখি। এখানে আমার বাবার সহকর্মীরা রাতের খাবার টেবিলে বসে তাদের পরবর্তী পাঠ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে। এখানে আমার বন্ধুরা আমাকে ছোট মাছের কাবাব খাওয়ানোর জন্যে জোরাজোরি করে, কারণ এই খাবারে অনাগত বাচ্চা স্বাস্থ্যবান হয়। এই দেশটা আমার মা এবং বাবার- যারা কোনো ভুল করেন না। তারা কোথাও যাচ্ছেন না।
আমি কৃতজ্ঞ, বিশেষত তাদের কাছে যারা সেই মুহূর্তে বাবার পাশে ছিলেন এবং খুব দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। তারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে আমার বাবার যত্ন নিয়েছেন। ধন্যবাদ। সারাদেশে যারা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আপনাদের প্রতিবাদের শব্দ আমার মনে শক্তি জোগায়। গত কয়েকদিনে যারা আমাদের জন্য ভালোবাসার অপার সমুদ্র খুলে দিয়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ। আপনার ঠিক সেটাই যা আমাদের প্রয়োজন।
কোনো ভুল করবেন না। আমরা কোথাও যাচ্ছি না।