নেপালে বিমান দুর্ঘটনা
স্বজনের শোকে রাষ্ট্রের সমবেদনা
মনুষ্য জীবন চিরতরে অন্তর্হিত হলে তা চাইলেও আর ফেরৎ পাওয়া যায় না। আর সেই যাওয়াটা যদি হয় অকালে অপঘাত-দুর্ঘটনায় তবে শোক বিহ্বল স্বজনেরা কিছুতেই সান্ত্বনা খোঁজে পান না। ত্রিভুবন ট্র্যাজেডি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে শোকগ্রস্ত মানুষের কারুণ্য কী প্রকারের হতে পারে। কন্যা বা স্বামীহারা স্ত্রীর আহাজারি, পুত্রহারা মায়ের হাহাকার, সন্তানহারা পিতার আর্তনাদ বড় বেদনার্ত করে দেয় আমাদের মন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের বেঁচে থাকবার সময়কাল এমনিতেই বেশ ক্ষণস্থায়ী। সেই ক্ষণকালও যদি বিয়োগ বিভাজিত হয়ে অল্পায়ুতে নেমে আসে তবে তা বড়ই অসহনীয়। স্বজনহারা যারা বেঁচে থেকে সেই মর্মযাতনা উপলব্ধি করে তারাই জানে কী দুঃসহ তাদের যন্ত্রণা।
তবু এই অমৃত জীবন যিনি দান করেন সেই জীবনদেবতা বা মহাপ্রকৃতি কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া জীবনবিনাশী হঠাৎ কোনো বিপর্যয়ে রাষ্ট্র যদি পাশে থাকে কিছুটা হলেও হয়তো বেদনার ক্ষতে উপশম মেলে। ঘটনা তদন্তে হয়ত যান্ত্রিক দুর্ঘটনার মানবীয় বহুবিধ ভুল খোঁজে পাওয়া যাবে। সেই ভুল থেকে ভবিষ্যতে শিক্ষাও নেয়া যাবে। কিন্তু আমরা যা হারিয়ে ফেলেছি, ডাক্তার, সরকারি আমলা, সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার বা অন্যান্য পেশাজীবী যে সম্ভাবনাময় মানুষগুলোর সেবা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি হাজার মাথা খুঁটলেও তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। এমন এক বেদনাবিধুর পরিস্থিতিতে নেপালের বিমান দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগী হতবিহবল স্বজনদের জন্য রাষ্ট্রের সমবেদনাকে আমরা স্বাগত জানাই। রাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ সম্মাননায় নিহতদের মরদেহ দেশে এনে স্বজনদের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে, মন ভেঙ্গে যাওয়া স্বজনদের খোঁজখবর রাখছে, আহতদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করছে –এটা নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রাপ্য। শুধু প্লেন ক্রাশে মারা যাওয়াদের জন্য নয়, একজন বিপদগ্রস্ত প্রান্তিক মানুষসহ রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিকের জন্য এমনতর কল্যাণকামী হবে- এটাই আমাদের বরাবরের প্রত্যাশা।
ত্রিভুবন দুর্ঘটনার সাতদিন পর গত সোমবার বিশেষ রাষ্ট্রীয় বিমানে নেপাল থেকে ২৩ মরদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। প্লেন থেকে আর্মি স্টেডিয়ামে নেওয়ার পর দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের স্পীকারের পক্ষে শ্রদ্ধা জানানো শেষে মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়ছে। অশ্রুসিক্ত স্বজনেরা তাদের নিকটজনের নিথর দেহগুলো সমাধিস্থ করতে বুঝে নিয়েছেন।
গেল ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের বোম্বার্ডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ ৪০০ মডেলের বিমান বিধ্বস্ত হলে ক্রু ও যাত্রীসহ ৭১ আরোহীর মধ্যে ৫১ জন মারা যান। এদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি হলেও তিনজনের লাশ শনাক্ত না হওয়ায় ২৩ জনের মরদেহ দেশে আনা গেছে।
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় যে ১০ বাংলাদেশি প্রাণে বেঁচে গেছেন, তাঁদের মধ্যে সাতজন ইতিমধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য একজনকে ভারতে এবং আরেকজনকে পাঠানো হয়েছে সিঙ্গাপুরে। অন্য আহতরা সরকারি তত্ত্বাবধানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন।
মারা যাওয়া মানুষের আহত স্বজনরা এই দুঃখভার কেমন করে বইছেন তা জানেন ঈশ্বর। গাজীপুরের আলমুন নাহার অ্যানি তাঁর প্রিয়তম স্বামী ফারুক হোসাইন প্রিয়কসহ একমাত্র কন্যা তামাররা প্রিয়ন্ময়ীকে হারিয়ে বাঁকরুদ্ধ। চোখের জল শুকিয়ে যাওয়ায় কাঁদতেও ভুলে গেছেন তিনি। বিধ্বস্ত প্লেনটির অভিজ্ঞ পাইলট আবিদ সুলতানের মারা যাওয়ার শোকে তাঁর স্ত্রী আফসানা খানম ব্রেন স্ট্রোক করে হাসপাতালে মারা গেছেন। তাদের শিশু সন্তানের কী হাল এখন তা সহজেই অনুমেয়। এমন বিয়োগান্তক করুণ কাব্যে ভারী হয়ে আছে বিপাকে পড়া প্রতিটি পরিবারই। নেপাল থেকে বাংলাদেশে ডাক্তারি পড়তে এসেছিলেন যে নেপালি শিক্ষার্থীরা তারা ফিরেছেন লাশ হয়ে। এমন শোক বইবার শক্তি কারো কি থাকতে আছে। বিমান ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হওয়া প্রতিটি পরিবারে এখন চলছে এমনতর শোকের মাতম। হয়তো সবাই একদিন ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু যে পরিবারটি তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকার হারিয়েছে তারা দুঃখ সামাল দেবেন কীভাবে আমাদের জানা নেই। গতকাল আর্মি স্টেডিয়ামে নিকটজনদের মরদেহ গ্রহণ করবার কালেও স্বজনদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়েছিল সেখানকার বাতাস। এতগুলো পরিবারের বুকে চেপে রাখা যূথবদ্ধ বেদনার স্রোত মিলে গিয়েছিল এক মহাদুঃখের মোহনায়।
আমরা কায়মনোবাক্যে চাইব এমন মন ভেঙ্গে দেয়া দুর্গতি কিছুতেই যেন কোনোদিনও আর কারো জীবনে ফিরে না আসে। মানছি নিয়তির ওপর কারও হাত নেই, আকাশচারী যান, জলচর কিংবা ভূপথগামী বাহনের যান্ত্রিক গোলযোগও ঠেকানোর কোনো উপায় নেই তবু অধিকতর সতর্কতা আমাদের আরো বড় বিপদ থেকে নিশ্চয় দূরে রাখতে পারে। আমাদের রাজনীতিবিদ, নীতি নির্ধারক বা গবেষকরা নিশ্চয় যন্ত্রকৌশল বিষয়ে আরো বেশি মনোযোগী ও সত্যনিষ্ঠ দায়িত্ববান হবেন। আমরা মানুষের অকাল বিয়োগের কান্নার সাগরে এমন করে আর ভাসতে চাই না।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, প্নেন ক্রাশের ঘটনা যতটা সবার দৃষ্টি কেড়েছে, সরকারের মনোযোগ পেয়েছে দেশের অপরাপর দুর্ঘটনা-দুর্যোগে ব্যাপক প্রাণহানিতেও এমন আলো পড়ে না। সড়কযান দুর্ঘটনায় রোজ মানুষ মারা যায়, স্বজন হারিয়ে পরিবারগুলো পথে বসে তাদের খবর আমরা কেউ রাখি না। দুবছর আগে নৌরুটে পিনাক লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত মানুষের প্রাণ গেলেও তাদের জন্য রাষ্ট্র দূরে থাক স্থানীয় সরকারের সম্মাননাও জুটেনি। এমনকি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও কারো মনে হয়নি। স্বজনহারারা ক্ষতিপূরণও পেয়েছে যৎসামান্যই। প্নেনে ভ্রমণকারীরা তবে কি সমাজের চোখে আলাদা কিছু কিংবা বেশি মর্যাদাবান? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন সমাজবিজ্ঞানী বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। আমরা সাধারণেরা শুধু এইটুকু বলতে পারি, প্রকৃতির কাছে মুটেমজুরের জীবনের মর্যাদা যা রাজার জীবনের দামও তাই। কিন্তু প্রকৃতির সাম্যবাদ তো মনুষ্য সমাজে অচল। তবু আমাদের রাষ্ট্র যে শ্রেণিবদ্ধ বিপন্ন মানুষের দিকে হলেও তার সহৃদয় দৃষ্টি দিয়েছে এই অভ্যাসটাই একদিন তাকে আচারনিষ্ঠ সাম্যবাদ শিখিয়ে দিয়ে যথার্থ কল্যাণরাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাবে। তেমন সুসভ্য, প্রেমময় ও সুন্দর সময়ের প্রত্যাশা আমাদের সবার।
জীবন যার দয়ার দান সেই মহাস্রষ্টা নিশ্চয় নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বালিয়ে রাখতে তাঁর সৃষ্ট দেহখানি তুলে ধরে নিজের দেবালয়ের প্রদীপ করেছেন। দহন দানে জীবন পুণ্য করেছেন। অসীম আকাশে প্রদীপ হয়ে যাওয়া সেই মৃত্যুঞ্জয়ী তারাদের দেখে দেখে আমাদের নয়নের দৃষ্টি হতে সব কালো একদিন ঘুচবে। সব ব্যথারা তার নিদারুণ শোক ভুলবে। সুশান্তি ও শুদ্ধতায় ভরা থাক সবার দেহাতীত অন্তরাত্মা। আমাদের প্রাণান্ত সমবেদনা স্পর্শ করুক স্বজনহারা সব পরিবারে। অবিরাম আমাদের সতত সমস্বর প্রার্থনা হোক এটাই-
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।
তব, পুণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর
মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।
মলিন মর্ম মুছায়ে ।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন