কোটা বিতর্ক
কোটাপদ্ধতি সংস্কারের এখন কোনো বিকল্প নেই
কোটা সংস্কারের পক্ষে বেশ কয়েকবার লিখেছি। আবারও লিখছি। কোটা সংস্কারের পক্ষে লিখলে অতি উৎসাহীরা মুক্তিযুদ্ধ-বিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। কিন্তু কোটা সংস্কার মানে কোটা বাতিল নয়। সংস্কার মানে কোনো অসংগতির সমাধান। আমি নিজে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের একজন ঘোর সমর্থক। বর্তমানে তিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। কোটা সংস্কারের পক্ষে যতবার লিখেছি সবসময়ই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই লিখেছি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ অসম্মানিত করলে তার প্রতিবাদ জানিয়েও অনেক কলাম লিখেছি।
আমি মনে করি, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সম্মান দেওয়া হয়, তা তাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অবদান বিবেচনায় খুবই সামান্য। আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়াও নানা ধরনের কোটা রয়েছে। এমনকি কোটা প্রয়োগে যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। কোটার ভেতরে কোটা প্রয়োগের বিষয়টিও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। মূলত কোটা বাতিলের জন্য বরং কোটার প্রয়োগের পদ্ধতি সংস্কার এবং কোটার পরিমাণ যৌক্তিক পর্যায়ে আনার দাবিতে সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলনে নেমেছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে এর আগে বহুবার সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলেও এবারের আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। গতকাল থেকে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেভাবে আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তা থেকে তাদের পিছু হটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আন্দোলনে যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত না লাগে সেজন্য শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’কেই ব্যবহার করছে। অনেক শিক্ষার্থীর তাদের হাতে প্রদর্শিত প্লা-কার্ডগুলোতে বঙ্গবন্ধুর ছবি এবং তাঁর দেওয়া বক্তব্য লিখে রেখেছে। আবার অনেক শিক্ষার্থীর হাতে শুধু বঙ্গবন্ধুর ছবি। অনেক ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবিও হাতে রেখেছে তারা।
দীর্ঘদিন থেকে কোটা সংস্কারের পক্ষে যারা আন্দোলন করছে তাদের একটি শঙ্কা বারবার কাজ করেছে- সেটি হলো তাদের সরকারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার শঙ্কা। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ওপর নানা ধরনের মানসিক চাপও সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য অনেকেই এ আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী এই আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত আছেন। তবে খুব ন্যায্যভাবেই অন্য সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও যুক্ত আছে এই আন্দোলনের সাথে।
অনেক দিন থেকেই কোটা সংস্কারের পক্ষে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে আসছে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৪ মার্চ ৫ দফা দাবি নিয়ে স্মারকলিপি দিতে সচিবালয় অভিমুখে যেতে চাইলে পুলিশি ধরপাকড় ও আটকের শিকার হয় তিন আন্দোলনকারী। এরপর আরো বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে রাস্তায় নামে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের পাঁচ দফা দাবি হলো- সরকারি নিয়োগে কোটার পরিমাণ ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, কোটার যোগ্য প্রার্থী না পেলে শূন্যপদে মেধায় নিয়োগ, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অভিন্ন বয়সসীমা, নিয়োগপরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহার না করা।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক সাধারণ শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনে থাকতে চাইলেও তাদের ওপর হঠাৎ পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলা এই আন্দোলনে আরো গতি এনে দিয়েছে। গত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করছে। ক্রমশই এই আন্দোলনের গতি পরিবর্তন হচ্ছে। এমনকি পরিবর্তন হওয়ার আরো আশঙ্কা রয়েছে। অনেকেই এই আন্দোলনকে সরকারবিরোধী কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে আসছিল অনেক দিন থেকে। এমনকি অতি উৎসাহ দেখিয়ে এর বিরুদ্ধাচারণ করতে দেখেছি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। যারা এমন অতি উৎসাহ দেখাচ্ছিল তারা মনে হয় আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে দেওয়ার লক্ষ্যেই পুঁজি করতে চেয়েছিল। যেকোনো সময়ের ছাত্র আন্দোলনকে উস্কে দিয়ে কোনো সুষ্ঠু সমাধান করা সম্ভব না। এখন এই আন্দোলনের যে রূপ দাঁড়িয়েছে, তাতে সংস্কারের পক্ষে না গিয়ে কোনো উপায় থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাহলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির আগে এর সমাধান করাটাই খুব বেশি ন্যায্য ছিল। যদিও প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। এই আলোচনার ফলাফল ছাত্রদের আন্দোলনকারীদের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি দেখা যাচ্ছে। দেশের সাধারণ ছাত্ররা যখন কোনো দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়তে পারে তখন সেই দাবি না মানা পর্যন্ত তার ইতিবাচক সমাধান ছাড়া সেটি মীমাংসিত হওয়া কঠিন। কাজেই এই মুহূর্তে আমি প্রত্যাশা রাখছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কোটা সংস্কারের একটি ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত সমাধান সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের মুখে হাঁসি ফোটাবে।
লেখক : ড. সুলতান মাহমুদ রানা, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ।