কোটা সংস্কার
তরুণদের প্রতিবাদেই মিলে তবে মুক্তি
ন্যায্যতাপ্রত্যাশী আমাদের তরুণরা চেয়েছিল কোটা সংস্কার আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিলেন, সরকারি চাকরিতে কোটাই থাকবে না। আপাতদৃষ্টিতে ঘোষণাটি অভাবনীয় ও বিস্ময়কর মনে হতে পারে; কিন্তু পুরোদস্তুর অবাস্তব নয়। বাংলাদেশের এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের প্রধানমন্ত্রী যুবসমাজের পালস বুঝেই নিশ্চয় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকারি বা বেসরকারি চাকরিদাতা সংস্থাগুলো যদি নিজেদের বিচার, বিবেক ও বিবেচনা দিয়ে সবার জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা দিতে পারে, সেখানে আলাদা করে কোটা ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন পড়ে না।
ছাত্র আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলে দিয়েছেন, ‘তারা চায় না, তাহলে দরকারটা কী। কোটা পদ্ধতিরই দরকার নেই। যারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী তাদের অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারব। এই আন্দোলন যারা করেছে, যথেষ্ট হয়েছে, এখন তারা ক্লাসে ফিরে যাক।’
আমরা সগর্বে উচ্চারণ করে যাই, প্রজাতন্ত্রের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু লাখো শিক্ষিত তরুণ যখন দেখে তাদের পূর্বপুরুষের মুক্তিযোদ্ধা সনদ কিংবা কোনো একটি গোষ্ঠীগত পরিচয় নেই বলে তাদের মাত্র তেতাল্লিশ ভাগ সুযোগের মধ্যেই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে চাকরি নামক সোনার হরিণের দেখা পেতে হয়, তখন বঞ্চিত সেই তরুণকে আর কোনো সান্ত্বনাতেই ঘরে রাখা যায় না। রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। তারা এত দিন বিভিন্ন ফোরামে বলে এসেছে। হতাশা আর রাগে নিজেরা নিজের মাথার চুল ছিঁড়েছে। এইবার তারা সংঘবদ্ধ হতে পারল। এবং একটি পরিচ্ছন্ন, অহিংস ও প্রত্যয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিল, আজকের যুবসমাজ ঝিমিয়ে পড়েনি। পুলিশের ভয় দেখিয়েও তাদের ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। নব্বই দশকের সেই স্বৈরাচার আন্দোলনের অনেকদিন পর শুধু ছাত্ররা তাদের দাবি আদায়ে আপন শক্তি রাষ্ট্রকে দেখাতে পারল।
দেশের নানা দুর্বিপাকে বরাবর এই ছাত্ররাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে ষাটের দশকের সেই ছয় দফাতে যার সূত্রপাত। সে সময়ের ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই একজন বঙ্গবন্ধু আবির্ভূত হয়ে বাংলাদেশকে তার আপন ঠিকানার সন্ধান দিয়েছিলেন। যুগে যুগে ক্ষমতাসীনরা এমন প্রতিবাদীদের প্রতি কুর্নিশ করেই এসেছে। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের যে যুবশ্রেণির বহু সাধনায় পাওয়া কেবল ওই শিক্ষাটুকুই সম্বল। বাপদাদার প্রভাব প্রতিপত্তি, অঢেল ভূ-সম্পত্তি, মামা-খালুর জোর, দলীয় লেজুড়বৃত্তির অসীম ক্ষমতা, অন্যায় পথে অর্জিত পরের ধনে পোদ্দারি করার ইচ্ছে বা উপযোগ্যতা যাদের কোনোকালেই নেই বা ছিল না। সেই তাদের যখন বঞ্চনায় পিঠ ঠেকে যায় তারা তখন দেখিয়ে দেয়, নিজেদের জাত চিনিয়ে দেয়। বছরের পর বছর চাপিয়ে দেয়ে কোটা নামের বৈষম্যের অবদমন এবার তাই রূপ নিল মহাবিস্ফোরণে।
প্রতিটি ন্যায্য আন্দোলনের মতোই কোটা সংস্কার আন্দোলনেও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন প্রথম দিকে এই আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও শেষ সময়ে তারা ভুল বুঝতে পেরে আপামর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সরকারি চাটুকারিতায় মাততে গিয়ে ছাত্রদের ভুল বুঝেছে। একপর্যায়ে কোনো সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাসভবনে হামলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। শিক্ষকের বাসায় হামলা অতি অবশ্যই নিন্দনীয়। পরে অবশ্য দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির নেতারা রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ছাত্র আন্দোলনের যৌক্তিকতায় সমর্থন দিয়েছে। স্মরণকালে এমন আন্দোলন একটাও দেখা যায়নি যেখানে জ্বালাও-পোড়াও, ব্যাপকভিত্তিক হামলা ভাংচুর বা প্রাণহানির ঘটনা ছাড়াই রাষ্ট্র দাবি মেনে নিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনরত ছাত্র ও সরকারপক্ষ উভয়েই আমাদের অভিবাদন পেতেই পারে।
তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা না রাখার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে খোদ আন্দোলকারীদেরও দ্বিমত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান মিডিয়াকে জানান, তাঁরা কোটা তুলে দেওয়া হোক চাননি, সংস্কার চেয়েছেন। কোটা থাকবে না, তা আমরা চাই না। আমরা সংস্কার চাই। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। কোটার দরকার আছে। সবার কথা বিবেচনা করে সেটার একটি সহনীয় পর্যায়ে সংস্কার চাই। কোটার বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি বক্তব্য চান তাঁরা।
আমাদের বক্তব্যও ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অনুবর্তীই। আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ যাঁরা এনে দিয়েছিলেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের সুবিধা দেওয়ার জন্য বাহাত্তরে কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা আর নেই। এমন বাস্তবতায় মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য ৩০ ভাগ কোটা রেখে দেওয়ার যুক্তিও তাই আর নেই। এ ক্ষেত্রে বরং মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য অন্যবিধ সম্মাননা বা সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে এ সময়ের আন্দোলনকারীদের অধিকার এতটুকু ক্ষুণ্ণ হবে না।
সব জেলার সুষম উন্নয়ন আমরা এখনো করে উঠতে পারিনি। অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো সেবা বা শিক্ষার ক্ষেত্রে সমতলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যায়নি। সেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য সহজলভ্য বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে দিতে পারিনি। কাজেই তাদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি অনুগত রাখতে সুযোগের প্রণোদনা দেওয়া ছাড়া এখনো অন্য কোনো উপায় নেই। আদিবাসীরা যখন কোটা সুবিধায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের আচার ও সংস্কৃতির ভাববিনিময় করে তা বহুত্ববাদী গণতন্ত্রকেই পোক্ত করে। জাতি ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানুষে মানুষে সহাবস্থানের সোপান বিনির্মাণ করে। তা ছাড়া বাংলাদেশে এখনো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীর সমঅধিকারকে স্বীকার করে না। নারী যে পুরুষের সমান্তরালে সমানভাবে কাজ করতে সক্ষম, এটা বিশ্বাস করে না। সমাজে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত হলেও তাদের স্বাভাবিক মানুষের মতো সম্মান দিতে শিখিনি আমরা। কাজেই জেলা কোটা, উপজাতি বা আদিবাসী কোটা, নারী কোটা এবং প্রতিবন্ধী কোটা সমূলে তুলে দেওয়ার আগে অবশ্যই দ্বিতীয়বার ভাববার অবকাশ আছে। কিন্তু সর্বোপরি ২৫৮ ধরনের উদ্ভট কোটার ৫৬ ভাগ অভিশাপ আমরা আমাদের মেধাবী তরুণদের ওপর কিছুতেই চাপিয়ে দিতে পারি না।
আমাদের যুবসমাজকে আস্থায় রেখে অবশ্যই যুগোপযোগী চিন্তা করতে হবে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৯(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে’ যেমন আমরা মানতে বাধ্য পাশাপাশি ২৯-এর (৩) এর (ক) তে বর্ণিত, ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না’ও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
তরুণদের প্রতিবাদে আছে অসীম শক্তি। তারা এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিশ্চয় নেবে না, যাতে দেশ পিছিয়ে যায়, মানুষের অবনমন ঘটে। কবি হেলাল হাফিজের অবিনশ্বর পঙক্তি, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার’ নিশ্চয় আমাদের তুখোড় তরুণদের উপজীব্য। তরুণদের আজকের এই যুদ্ধের নাম, সকল অসাম্য ও বৈষম্যের মূলোৎপাটন, অন্যায় ও অসত্য তিরোহিতকরণ, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা, চাপিয়ে দেয়া অশুভ শৃঙ্খল ভেঙে দেওয়া আর ইতিবাচক পরিবর্তনে সরব থাকা। আমাদের তরুণরা চিরসুন্দর। তাদের প্রতিবাদেই মিলবে আবদ্ধ সকল সুন্দর ও শুভবোধের মুক্তি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।