বং এক্সপ্রেস
ভালো রাখি, ভালো থাকি
নতুন বছর, বাঙালির নতুন বছর ১৪২৫। এই আমরা ঢুকে পড়েছি। জোড়া জোড়া মাস নিয়ে এখন আমাদের ঋতুযাত্রা শুরু হলো। এই বৈশাখ আগমনীর মতো। পয়লা বৈশাখ কিংবা পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশে তা কত বড় উৎসব, তা না বলাই ভালো! কিন্তু এই বাংলায় উৎসবের তোড়জোড় তেমন যদি নাও হয়, তার প্রভাব কিন্তু এড়াতে পারে না। এই বিদেশের প্রভাবে ত্বরান্বিত বং কালচার কিন্তু বাঙালির সব নিতে কখনই পারবে না, কারণ নিজস্বতার একটা সৎ জোর থাকে, সেটাই তার জিইয়ে থাকার গুণ। যাই হোক যেটা বলছিলাম, বৈশাখ আর নতুন বছরের উৎসব ও তার অভিধা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে তার আনুষঙ্গিকতাতেও যেমন ফুটের দুইধারে শতাংশ লেখা চৈত্রের সেল, জামা-কাপড়ের বিছিয়ে থাকা নধরকান্তি দেহ, এসব আপনি এড়িয়েও এড়াতে পারবেন না। আর এই যে ফেসবুক আর নতুন যান্ত্রিকতাকে আমরা মাঝেমধ্যে তুলাধোনা করি তাদের প্রাবল্যে কিন্তু মা কিংবা বাবার বং কালচারের নতুন ছেলে বা মেয়েটি পয়লা বৈশাখ দেখতেও পেয়ে যাচ্ছে সুন্দর ছবিসহ।
এবারও তো বাংলাদেশ হাইকমিশন কলকাতা শহরে অপূর্ব এক বৈশাখী আয়োজন করেছে, চড়ক, নাগরদোলা, পুতুলনাচ, পিঠে-পুলি নানা কিছু। আসলে বছর বা সময় অস্থির চলমান জীবনের নতুন যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তা নয়, কিন্তু আমাদের সময় তো ক্রমবহমান তার মধ্যে যদি বিশেষত্বকে হারিয়ে ফেলি বেঁচে থাকার মুহূর্ত পরিশুদ্ধ হবে না। এক একটা সময় আসে বিষণ্ণতার, দুঃখের কখনো কখনো সামনে সুখ এসে দাঁড়ালে মনে হয় দুঃখকে সে পরিহাস করে। কিন্তু এটা খুব স্বাভাবিক নিয়ম ভালো সে যত কম ভালোই হোক আর খারাপ সে যত বেশি খারাপই হোক, কেউ বেশিক্ষণ স্থায়ী নয়। পয়লা বৈশাখের সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা বাচ্চা যখন শোনে মামণি ওঠো, বিকেলে বেরোব, তুমি তোমার নতুন জামাটা পরো। তার পুলক তৈরি হয়। প্রতিদিনের দৌড়ানো, স্কুল, তার যে মুখ ক্লান্ত করে তোলে সেই মুখই আলোকিত হতে থাকে। আর এই বৈশাখ শুনলেই মনে হয় শ্বেত শুভ্র কি যেন ভেসে আসছে, ধেয়ে আসছে। আপনার আমার প্রতিদিনের কর্ম আমাদের নির্মম করে তোলে। আমরা এ ওকে পার হয়ে প্রতিদিন ছুটে বেড়াই, কোথায় কার কী হলো বুঝতেও চাই না। হয়তো এ রকম একটা দিনেই আপনার এসি বাসটা হাওড়া ছাড়িয়ে এগোচ্ছে আর ব্রিজের নেচে দেখলেন দুটো ধুলোমাখা বাচ্চা দৌড়াচ্ছে। যাদের নতুন বছর নেই, নতুন জামা নেই।
তারপর আপনার মেয়েটির দিকে তাকালেন আর আপনার নিজেকে সুখী মনে হলো, একটা লম্বা শ্বাস বেরোল, দুফোটা চোখের জল এলো কি এলো না, কিন্তু একটি চেতনা জাগ্রত হলো। হয়তো এই অনুভূতি আপনাকে কোনো দান শেখাতে পারে একটা মুহূর্তের জন্য। আসলে ইংরেজি বছরের আগমনের মধ্যে একটা ফর্মাল বোধ কাজ করে, ডিস্কো, কেক, ওয়াইন তারপর পার্টির ড্রেসকোড ফলে যেন একটা পোশাকি তোড়জোড় লাগে। মানে ধরুন আপনি অফিসে যাকে বোন বলে ডাকেন সে আপনার বাড়িতে এলো আপনি একটু সতর্ক হয়ে তার আতিথেয়তা করবেন নিজের বোনকে কখনই নয়। সে রকম বাঙালির গেরস্থালিতে যা আছে, তা দিয়ে বসে বসে উপভোগ করার জন্য পোশাকি তোড়জোড়ের চেয়ে বেশি ঘরের মেয়ে ঘরের মেয়ে বলে তাকে আদর করা যায় এই বাংলা বছরকে। আমের পল্লব, আম গাছের হাওয়া, ঘটে স্বস্তিক চিহ্ন, বাচ্চাদের হাতকাটা সুতির টেপ, বারান্দার জুঁই ফুলের গন্ধ, বিকেলে শিঙাড়া-মুড়ি, কালো মেঘ করে সে কালবৈশাখী আর তার বৃষ্টি যা থেকে বেরোতে না পারার ভয় ও আনন্দ, গন্ধরাজ লেবু আর ডাল ভাত বড়া দিয়ে, এঁচোড়ের ডালনা—এসব পয়লা বৈশাখের আগমনী সাজগোজ যা আমরা হাড়-জিরেজিরে থেকে মোটা সকল মানুষ হেব্বি মজা করে উপভোগ করি।
বাংলার ঘরে ঘরে যে দুঃখের ইতিহাস পড়ে পড়ে আমরা বড় হয়েছি। যেখানে জানলার হাওয়া আর হারিকেনের আলোর মেলবন্ধন না হলে সন্ধ্যে যেন নিজেই বলে আমি আসব না ঘরে ঘরে। সেইসবই তো গরমকালের ইতিহাস—এই গ্রীষ্মপ্রধান নদীমাতৃক দেশ যার শরীরে ঘাম না দেখলে তাকে চেনা যায় না তার ভূমিকায় তো এই পয়লা বৈশাখ।
আমাদের যে টুকু দৃশ্যত সত্য তা এই বেঁচে থাকা, অক্লান্ত বেঁচে থাকা। আমার মনে আছে আমি আমার মায়ের ঠাকুমার কাছে শুয়ে শুয়ে বাংলাদেশের গল্প শুনতাম, ফ্যানের হাওয়া তিনি সহ্য তেমন করতে পারতেন না। বারবার দেখতাম কারেন্ট আছে তবু উনি তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া খাচ্ছেন। আমাদের যাদের জন্ম ’৯০-পরবর্তী তার কারেন্ট না থাকা কী জানতাম না তেমন লোডশেডিংও তেমন বুঝতাম না, কারণ কারেন্ট না থাকলে ব্যাটারি চলত। তো এই বম্মাকে (মায়ের ঠাকুমা) দেখেছি পয়লা বৈশাখ কিংবা অক্ষয় তৃতীয়ার মিষ্টি সাজাচ্ছেন থালায় থালায় আর সাদা ধপধপে থান পড়ে কালো চশমা পরে ঘেমে নেয়ে উঠছেন কিন্তু হাওয়া খাচ্ছেন ওই তালপাতার পাখায়। কেউ ফ্যান চালালে বিরক্ত বোধ করছেন, নতুনবছরে সেই নতুন রূপে গায়ে লেস লাগিয়ে সেই হাত পাখা হাতে স্থান পেয়েছে।
তো এভাবেই ছোট ছোট আদরে-আহ্লাদে, স্মৃতিতে সে বছরের প্রথম বিশেষ দিন হয়ে ওঠে। আর আমরা যে মানুষ তাই আমাদের গড়া সমাজকে সাজানোর সুখ তো আমাদের মধ্যেই প্রবাহিত হতে হবে। নতুন বছর আসলে একটা সুযোগ আমাদের ভালোগুলো রেখে খারাপগুলো পরিশ্রুত করার সুযোগ, ভালো থাকানো আর ভালো থাকার সুযোগ।
লেখক : কবি, পশ্চিমবঙ্গ।