ফিকে হওয়া স্বপ্নে গুমড়ে মরা আর্তনাদ
আরো কত দুর্ঘটনার ছবি দেখতে হবে আমাদের, লিখতে হবে অকাল মৃত্যুর খবর? আর, সড়কের নিরাপত্তা, বেপরোয়া পরিবহন ব্যবস্থা নিয়েই বা রাজনৈতিক রক্ষাকবচের লীলাই বা দেখতে হবে কত দিন। ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।’ জীবনান্দের মতো ক্লান্ত ঢাকাবাসীও। এই নগরবাসীর বনলতা সেন নেই, আছে সড়কে মৃত্যুদূতের সরব উপস্থিতি। প্রতিদিনকার সড়কে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর থেমে থেমে বিরতি দিয়ে লম্বা হওয়া মৃত্যুর মিছিলে আমিও শঙ্কিত।
এই যে, সড়ক দুর্ঘটনায় ডান হাত হারানো সেই রাজীব মারা গেলো। বাসের রেশারেশিতে পিষ্ট হওয়া ছেলেটার খবরটা দেখার পর গা শিউরে উঠে। অবসর হয়ে যায় শরীর।
রাজীব, যেন রাজধানী শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই প্রতিবিম্ব। ২১ বছর বয়সের টগবগে এই তরুণের অকাল, অপ্রত্যাশিত মৃত্যুই চোখে আঙুল দিয়ে আবারও দেখিয়ে দেয়, ঢাকার রাস্তায় আমাদের নিরাপত্তাহীনতা। কত ঝুঁকি নিয়ে চলছি আমরা।
গেল কয়েকদিন ধরেই রাজীবকে নিয়ে গণমাধ্যমের সংবাদগুলো ভাসছে চোখে। আহা রে। মা বাবার আদর জোটেনি ছেলেটির ভাগ্যে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বাবা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনিও না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। এতিম রাজীব বেড়ে উঠতে থাকে নানীর কাছে। নানীও তাকে ছাড়া চলে যান কিছু দিন পর। এর পর বড় হতে থাকেন খালার আশ্রয়ে। সেই রাজীবের শেষ বিদায়টাও হলো অত্যন্ত করুণভাবেই। মানুষের বাড়িতে প্রাইভেট টিউশনি করে বড় হচ্ছিলেন রাজীব। পড়ালেখার ফাঁকে একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে নিজের আর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই ভাইয়ের খরচ চালানোর সংগ্রাম করে আসছিলেন এই তরুণ। তার আর ভালো কিছু করা হলো না। নিভে গেল জীবন প্রদীপ।
কিন্তু রাজীবই তো তালিকার শেষ ব্যক্তি নয়। বরং, প্রতিদিন তালিকাটা বড় হচ্ছে একটু একটু করে। গতকাল সোমবারই তো রাজধানীর জুরাইনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন হাফিজার রহমান (৮০) নামের এক ব্যক্তি। সন্ধ্যায় জুরাইন বউ বাজার এলাকায় একটি গাড়ির ধাক্কায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। আগের দিন কিশোরগঞ্জে ট্রাক্টর ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে তিনজন মারা যায়। আর বাস-ইজিবাইক সংঘর্ষে নিহত হয় আরো চারজন নওগাঁয়।
অথচ সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা, সড়কে যান নিয়ন্ত্রণ, প্রাইভেট কারের দৌরাত্ম কমানো, বেপরোয়া যান নিয়ন্ত্রণ... নিয়ে কত কথাই শুনছি আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর কাছ থেকে। তিনি কথা বলেছেন, তাঁর আগের মন্ত্রী বলেছেন, তাঁরও আগের মন্ত্রী বলেছেন, তাঁর আগে যিনি ছিলেন, তিনিও বলেছেন। আমাদের নগর পিতারা নাম, পদবির সিলমারা ব্যানার সর্বস্ব কত কর্মসূচি পালন করছেন। নানা উদ্যোগে গিনেজ বুকে নাম লেখানোর দৌড়ে আছেন। অথচ সড়কের পরিস্থিতি বদলায়নি এতটুকু। বরং নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে আরো।
ছোট্ট নগরীতে প্রায় তিন কোটি লোকের বাস। তাদের হাঁটাচলার জন্য রাস্তা দরকার। বর্তমানে যানজট অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ফুটপাত দিয়ে তারা হাঁটবে, সে উপায় নেই। গাড়ি ও মানুষ একই রাস্তায় চলছে। আবার একই রাস্তায় চলছে রিকসা, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল। তাদের মধ্যে আবার আগে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। পথচারীদরে মাঝেও রয়েছে বেপরোয়া মনোভাব। সড়কের ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস বা ট্রাফিক সিগন্যালকে থোরাই কেয়ার করেন অনেকেই। সবার মাঝে আগে যাওয়ার অদমিত প্রতিযোগ। তাহলে রাস্তায় নিরাপত্তা আসবে কীভাবে?
আমাদের ড্রাইভাররা স্বশিক্ষিত। মানে গাড়ি চালানোর দক্ষতা রপ্ত করেছেন তারা নিজে নিজেই। প্রাতিষ্ঠানিক দীক্ষা নেই। নেই নিয়মশৃঙ্খলা মানার ন্যুনতম বোধোদয়। তাদের আবার গাড়ি চালানোর সময়সীমা নেই। যত বেশি চালাতে পারবে, যত ট্রিপ, তত আয়। কখনো মালিকদের পক্ষ থেকেও চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্রামহীন ড্রাইভিং, সাথে বাড়তি আয়ের অবৈধ নেশায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন গাড়িচালকদের বড় অংশ। রাজধানীর সিটিং পরিবহনের চিত্রটি আরো ভীতিকর। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, প্রতিটি পরিবহনের গাড়িচালকদের মাঝে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা হয়। এই প্রতিযোগিতা শৃঙ্খলহীন, যার বাঁকে বাঁকে মৃত্যুর ঝুঁকি। গাড়ির যাত্রীদের প্রতিবাদের মুখে তাদের উল্লাস ধ্বনি, ... তাহলে প্রাইভেট কারে যান না ক্যা?
সরকার চাপে পড়ে হোক বা সদিচ্ছায়ই হোক, মাঝে মাঝে কিছু পদক্ষেপ তো নিয়েছেই। বাস্তবায়ন হয়নি তার কিছুই। এর বড় কারণ, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম, তাদের ধর্মঘট। যত অপরাধই থাকুক, চালকের সাজা মওকুফ করতে হবে। এটি তাদের মৌলিক দাবির একটি। আইন অমান্য করে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেওয়া, রাস্তায় পুলিশের তৎপরতা কমানোর দাবিও রয়েছে তাদের আবদারে। এসব আবদারে এ পর্যন্ত প্রায় ২৪ বারের মতো পরিবহন ধর্মঘট কর্মসূচিও পালন করেছে তারা।
ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি আরেক অস্বস্তির নাম। অফিসমুখী মানুষের বাসে ওঠার যুদ্ধ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যার নিয়মিত কষ্টের এক চিত্র। শত শত যাত্রী বাসের অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু গণপরিবহন কম থাকায় হতাশ হতে হয় অনেককেই। রাস্তায় দেখা যায় পরিবহনের বদলে ব্যক্তিগত গাড়ির দাপট। যেন ঢাকার রাস্তা ব্যক্তিগত গাড়ির জন্যই! সবশেষ তথ্যমতে, প্রতিবছর ঢাকার রাস্তায় নামছে ৬০ হাজারের মতো গাড়ি। যার ৮০ শতাংশেরও বেশি ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি। প্রত্যেক সদস্যদের জন্য গাড়ি রয়েছে, ঢাকায় এমন পরিবারের সংখ্যাও কম নয়। যানজট বাড়ানো বা দুর্ঘটনা ঝুঁকিতে তাদের ভুমিকাও কম নয়।
আসলে আমরা বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলছি। আমাদের দায়ের বড়ই অভাব। আমাদের বেশিরভাগ জনই নিয়মের বাইরে থাকতে চান। মূল্যবোধের স্তর ক্ষয়ে গেছে আমাদের। অবস্থা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে ভয় বাড়ছে। ভীষণ ভয় পাচ্ছি।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।