অভিমত
ছুটির ফাঁদে সেবা কাঁদে!
পত্রিকাওয়ালারা সব সময় খবর খোঁজেন। কিন্তু সব সময় কি আর মানুষের আগ্রহের খবর পাওয়া সম্ভব?
আগ্রহের খবর যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। বেসিক ব্যাংকের বাচ্চুকে দুদকে তলব। সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি। বিসমিল্লাহ গ্রুপের… এনেনটেক্স... ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার অন্যদিকে চট্টগ্রামে কোচিং মালিককে ছাত্রলীগ নেতার টানা চড়-থাপ্পড়। তারেক রহমানের পাসপোর্ট…। গণপরিবহনের নৈরাজ্য। কোটা সংস্কারে ছাত্রদের আন্দোলনে দেশ অচল। অর্থমন্ত্রী আবার বললেন রাবিশ। পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকা ছাড়াল। চালের মূল্য কমছেই না।
এ রকম শিরোনাম ছাপা হলে মানুষ হুড়মুড়িয়ে গোগ্রাসে গিলে। কাটতি বাড়ে পত্রিকার। সম্প্রতি দু-একটি পত্রিকার খবর ছিল এ রকম, নয় দিনের ছুটিতে বাংলাদেশ। কক্সবাজারে পর্যটকদের জমবে মেলা। ঘুরে আসুন বাংলাদেশের সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান।
প্রিয় পাঠক, সবিনয়ে বলি, এ ধরনের শিরোনাম আমাদের ব্যথিত করে। নিজেদের অলস জাতি বলে স্মরণ করিয়ে দেয়। যেখানে আমরা উন্নয়নের পথে হাঁটা শুরু করেছি, সেখানে এ ধরনের অতি উৎসাহ দেখানো কতটা যুক্তিসংগত, ভাবনার বিষয় সেটা।
বিষয়টা যদি এভাবে বলি, কে বলেছে সবার নয় দিনের ছুটি? ছুটি আসলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সাধারণ চাকরিজীবীদের বেলায়? তাও ছুটি হচ্ছে ২৭-২৮ এপ্রিল শুক্র-শনি, রোববার হচ্ছে বুদ্ধপূর্ণিমার ছুটি। হলো মোট তিন দিন। সোমবার খোলা। তারপর ১ মে শ্রমিক দিবস, ছুটি। ২ মে শবেবরাত, ছুটি। ৩ মে বৃহস্পতিবার খোলা। তারপর আবার ৪-৫ মে শুক্র-শনিবার। এই হলো মোট সাত দিন। কিন্তু নয় দিন ছুটি কাটানোর জন্য উসকে দেওয়া কেন? ভোগবাদী আর পুঁজিবাদী মানসিকতার পেছনে আসলে কোন মতলব কাজ করছে? যেখানে আমাদের সরকারি অফিসের দুরবস্থার কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। একটা ফাইল নড়াচড়া করাতে মাসের পর মাস লেগে যায়। একজন অবসর গ্রহণকারী ব্যক্তিই জানেন তাঁর পেনশনের টাকার জন্য কীভাবে অফিসে ঘোরাঘুরি করা লাগে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যেমন ওয়াসা-বিদ্যুৎ-তিতাস গ্যাস অফিসে একটা সংযোগ নেওয়ার জন্য বা অন্যসব কাজের জন্য কীভাবে ঘোরাঘুরি করতে হয়, একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে তোয়াজ করার পরও প্রয়োজনীয় সেবা পেতে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না। কিংবা ভূমি অফিস-সাবরেজিস্ট্রি অফিস রাজউক-গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো কাজে গেলে আজ না কাল, কাল না পরশু ছাড়া কথাই বলে না। সেখানে এই ছুটির খবর কতটা ব্যথিত করে, তা একজন ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ টের পায় না।
আমাদের অবশ্যই কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে একটু-আধটু ঘোরাঘুরির প্রয়োজন আছে। সেটাতে কোনো প্রকার দ্বিমত নেই। মানুষিক প্রশান্তি প্রয়োজন। কিন্তু একজন মানুষকে নয় দিন ছুটি কাটানোর উসকানি দেওয়া কতটুকু দেশের জন্য ক্ষতিকর, সেটাও বোঝা দরকার। কারণ, তাঁকে দুদিন টানা ছুটি নয়, গ্যাপ দিয়ে গ্যাপ দিয়ে ছুটি নেওয়ার কথা বলে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে যদি সরকারি অফিসের সবাই ছুটির আবেদন করেন?
হয়তো সবাইকে কর্তৃপক্ষ ছুটি দেবেও না। তারপরও যে লোকটি ছুটি পাবে, তার আনন্দ দেখে যে লোকটি বসের প্রিয়ভাজন না, তাকে সরকারি ছুটিতেই তৃপ্ত থাকবে। এর ফলে কী হবে? বৈষম্য সৃষ্টি হবে। এরপর আছে ইউনিয়নের ফেরেব্বাজি। অমুক দলের উনি, সুতারং তার ছুটি লাগবেই। সরকারি অফিসে অরাজকতার কূপির সলতের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এভাবে কি উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব?
সরকারি অফিস বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যে ভুক্তভোগীর কাজ রয়েছে অমুক বসের কাছে, সে গিয়ে ঘুরে আসবে। হয়তো তার ওই কাজের জন্য আরেকজনকে কথা দিয়ে রেখেছে, কিন্তু বস ছুটিতে থাকায় কাজটি হচ্ছে না। তার পুরো পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে।
আমাদের মতো দেশের জন্য সরকারি অফিসের টানা নয় দিনের ছুটি মানে কি পরিমাণ ক্ষতি, সেটা কেবল একজন প্রকৃত দেশপ্রেমী অর্থনীতিবিদই বুঝবেন। এর ফলে অর্থনীতির চাকা কতটা পিছিয়ে পড়বে, সেটা হিসাব করে দেখালেই কেবল বোঝা যাবে।
এমনিতেই আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপারে রয়েছে নানা অভিযোগ। ঠিকমতো অফিস না করা থেকে শুরু করে বসদের তেল মারার কাজে ব্যস্ত থাকা। তার ওপর ঢোলের বাড়ি দিয়ে ছুটি কাটানোর উসকানি দেওয়া কতটা দেশের জন্য আশাব্যঞ্জক, তা ভেবে দেখা দরকার, ঠান্ডা মাথায়।
দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম। নয় দিনের ছুটির ফলে সেবাগ্রহীতাদের কতটা ক্ষতি হবে, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। যাদের কাছে এ লেখাটি অপ্রিয় মনে হবে, তারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে লেখাটা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে, দেশের উন্নয়নের কথা ভেবে দ্বিতীয়বার পড়ার অনুরোধ থাকল।
শুধু মুখে মুখে বড় গলায় দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলে দাবি করবেন না, সত্যিকার অর্থেই দেশকে ভালোবাসুন।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।