বং এক্সপ্রেস
কু-ঝিক ঝিক
সেই ধোঁয়া ওঠা ইঞ্জিন, তার শিস, কাপড় ওড়ানো আজ আর নেই। আজ অনেক সংগত ও সুসংহত আমাদের যাত্রা তার মধ্যে বৈষম্য তো আছেই। সেই অপু-দুর্গার রেল দেখার উৎসাহ আজও আমাদের মনকে ভরিয়ে তোলে। আমার জন্ম ১৯৯০ সালে, তবে আমিও একফালি ট্রেন আমার মায়ের মামার বাড়ি নদিয়ায় ঘুরতে গিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে দেখেছি। আর তার ভেতরে অগণন মানুষের ভিড়, বাংলাদেশের লোকাল ট্রেনে এখনো গাড়ির ওপরে মানুষ বসে। বাংলার সাহিত্য জীবনে রেলগাড়ি বা ট্রেনের একটা অকপট প্রভাব আছে। আরো আছে ভূতের গল্পগাছা। আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় ছবিতে গল্প দিয়ে সেই বইগুলো পাওয়া যেত। তার মধ্যে ‘রেলগাড়িতে ভূত’ আমার খুবই প্রিয় ছিল। তা ছাড়া বিভিন্ন সরেস গল্পেও ট্রেনের প্রভাব খুব চাঙ্গা। এক অপরিচিত স্টেশন, সেখানে রাতে একটাই ট্রেন আসে কু-ঝিক ঝিক করতে করতে, তারপর সেই ভূতশুণ্ডি মাঠ।
এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প মনে পড়ল। আমার দাদু মানে মায়ের বাবা কিশোরগঞ্জের মানুষ ছিলেন, আমি আর আমার মাসতুতো ১০ মাসের ছোট ভাই বাবাই দুজনেই খুব ডানপিটে ছিলাম। দুজনের দেখা হলে দাদুবাড়িতে সকলে হেস্তনেস্ত হয়ে যেত। সারা দুপুর দাদুর স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো মোটরবাইকে পালায় পালায় উঠে, দুটো ঠোঁট এক করে কৃত্রিম কম্পন তৈরি করে মিছামিছি গাড়ি চালাতাম। সেই মহাদুপুরে কেউ আমাদের জ্বালায় চোখের পাতা এক করতে পারত না। কেবল রাতের বেলা দাদু আমাদের দুজনকে দুপাশে নিয়ে ভূতের গল্প বলতে শুরু করলে আমরা শান্ত হতাম। যেহেতু নিত্যই গল্প বলতে হতো, তাই গল্পের ভাণ্ডারও দাদুর ফুরিয়ে আসত। তো, দাদুর গল্প শুরু হতো এই প্রকারে—সে এক ফাঁকা স্টেশন, রেলগাড়ি এসে থামল, রামবাবু নামল এবার পথ দিয়ে রামবাবু যায়..., রামবাবু যাচ্ছে—
আর আমরা ভীতসন্ত্রস্ত রেলগাড়ি, ফাঁকা স্টেশন আর রামবাবু যায় এই আবহাওয়াতেই এত কম্পিত হতাম যে রামবাবুকে কোথাও পৌঁছতে হতো না। তার আগেই আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। কিছুটা বড় হয়ে বুঝলাম, রামবাবু যায় আর যায় বলেই আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হতো। তো, এই গল্প কেন বললাম কারণ রেলগাড়ি বা ট্রেন এর পথ ও পথের রহস্য এত তীব্র ও ঘনীভূত ছিল। যে তার আদলে আবহাওয়ায় বদলে যেতে পারত। প্রথম রেল তৈরি নিয়ে হলিউডে বেশ কিছু ছবি আছে, ভাবনা প্রয়াস সময়ের গতিপথ দেখলে চমকিত হতে হয়। পায়ে হাঁটা গতিপথ আর পৃথিবীকে স্থির অবস্থান থেকে দেখা হিসেবে জানালা ছিল গণ্ডি। বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে রেলের বিশেষ যোগ আছে, তা বলছি না। বলছি বাঙালির ভেতরে এই রেল বা ট্রেন নিয়ে এক আলাদা আবেগ আছে। ট্রেনে ভ্রমণরত বাঙালি পরিবার দেখলে বোঝা যায় তারা একটা জীবন গুটিয়ে রেলকামড়া নিয়ে এসেছ। সবচেয়ে ওপরের বার্থে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়া। বোঁচকা বা এখনকার ট্রলিব্যাগে ভর্তি করে লুচি-মাংস, মিষ্টি-রসগোল্লা-সন্দেশ, কদিন আগে এক পরিবারকে দেখলাম গুছিয়ে বাচ্চা-কাচ্চাসমেত মাছ ভাত নিয়ে ট্রেন বসে মহানন্দে তারা খাচ্ছে। এগুলো যে দারুণ কিছু আভিজাত্য, তাও আমি বলছি না; কিন্তু আবেগটা এত ঘরোয়া ও নিজস্ব যে সেখানে ঘর-বাহির পার্থক্য থাকে না; থাকে শুধু জানালা দিয়ে হাওয়া খেতে গতির সাযুজ্যে নিজেকে মেলে দেওয়া এবং পরিবর্তিত প্রকৃতির রূপকে উপভোগ করা। এই ক্রমাগত গতিময়তা ও তার স্টেশনের কাছে এসে বিরতি নেওয়া যেন একটা খেলা। বাঙালি রসিক ও ভ্রমণবিলাসী ফলে তার স্থিত মুহূর্তকে রূপান্তরে সে গ্রহণ করে। এই যেমন রেলের হকারদের ডাক, কুলিদের ডাক, বাদাম, কাঠিভাজা, পাপড়, ঘুগনি, গরম ডিমসেদ্ধ, কলা-শসা-পেয়ারা এর সঙ্গে লাল নুন, তারপর কচুরি, লাল-নীল লজেন্স, ঝালমুড়ি এক-একটা জীবিকা বড় হতে থাকে রেলের কোচে কোচে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চারমূর্তি’র গল্প নিয়ে যে ছবি, সেখানে ট্রেনই তো উত্তেজনার গ্রাফকে তুঙ্গে নিয়ে যায়।
রেলে আসলে একটা জীবন, ধীর থেকে দ্রুত তারপর বিরতি, ভিখারির টুংটাং পয়সা, বাউলের গান ও হরেকরকম জীবনের একটি গোটা সিনেমা...
লেখক : কবি, পশ্চিমবঙ্গ।