ঈদ মোবারক
রোজার শেষে এল খুশির ঈদ
মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর সাজানো গোছানো পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের মাঝে মায়ার বন্ধন এঁটে দিতে নানারূপে কঠিন প্রেম, গভীর সৌহার্দ্য ও অপার ভ্রাতৃত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। এর মধ্যে মুসলমানদের ঈদ পার্বন নিশ্চিতার্থেই অন্যতম। চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে বিশ্বের অন্তত দেড়শো কোটি মুসলমান বছরে দুইবার এই উৎসবে মাতেন। এক মাসের সংযম সাধনা শেষে ঈদ উল ফিতর আসে বলে এর গুরুত্ব খানিকটা বেশিই। এই ঈদে আনন্দের সাথে খাপ খাওয়াতে নিজেকে সাজিয়ে তুলবার আতিশয্যও তাই বেশ চোখে পড়ে।
ঈদ উদযাপনে শুধুমাত্র ধর্মীয় রিচুয়াল যে বড় হয়ে ওঠে তা নয়, বরং ঈদ এলে বিশ্বমানুষের মধ্যেই ছড়িয়ে যায় মৈত্রীর বার্তা। অন্তত একদিন হলেও ভাইয়ে-ভাইয়ে, বোনে-বোনে, পিতামাতা-সন্তানে, পাড়া-পড়শিতে কিংবা স্বামী-স্ত্রীতেও যে মহব্বতের ফল্গুধারা বয়ে যায় এই রেশটা বছর জুড়ে চললেই পৃথিবী হতে পারে আরও মানবীয় ও প্রেমময়।
ঈদ হতে পারে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব, কিন্তু এর অন্তর্গত মাহাত্ম হলো অসাম্প্রদায়িকতা ও চির সাম্যবাদ। এ যেন সর্বমানবের সম্মিলনেরই আলোকবর্তিকা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নতুন চাঁদ’ কবিতায় যেমনটা বলেছেন-
সাম্যেও রাহে আল্লাহর
মুয়াজ্জিনেরা ডাকিবে ফের
রবে না ধর্ম জাতির ভেদ
রবে না আত্ম-কলহ ক্লেদ!
সত্যিকার অর্থেই বাঙালি জীবনে ঈদ হয়ে ওঠে সকল দুঃখ ভুলানিয়া সুখপাখির অনন্য উদাহরণ। রোজই কত নেতিবাচক ঘটনা ঘটে চলে। আমাদেরও মন খারাপ হয় ভীষণ। কিন্তু ঈদ উদযাপনের এই ক’টা দিন যেন জাদুতে মোড়ানো। কোথাও কোনো দুঃসংবাদের ঘনঘটা নেই। ট্রাজিক উপাখ্যান নেই। মানুষ ফিরে এসেছে যার যার চিরস্থায়ী আপন নীড়ে। সেখানে এখন স্বজন সান্নিধ্যে কেবলই সুখবিলাস আর রূপকথার সুয়োরাণীর গল্পকেচ্ছা। প্রাণভরে বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস নেবার ফুরসৎ বুঝি এইতো। বছর জুড়ে নানা ঝুটঝামেলায় বুকের ঘরে যে ক্লেদ জমে তা পরিশুদ্ধ হয় এই পার্বণের শুভশুচিতায়।
কিন্তু বাংলাদেশে এই ঈদ সহজে আসে না। লাখো কর্মজীবীর শ্রমের মূল্যে আমাদেরকে খানিকটা সুখ কিনতে হয়। ঈদে তবু সেই শ্রমিক, মুটে, মজুর ও কৃষকের খোঁজ নেয়া হয়ে ওঠে সবার। কিন্তু দিনবদলের পালায় উৎসব ছাড়া বাকিটা সময় আমরা কে কার কথা মনে রাখি? বছর জুড়ে নানা শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে এত হিংসার বিষবাষ্প জমা হয়ে থাকে যে, সেখান থেকে ভালো মানুষের খোঁজখবর করবার দায় কেউ বোধ করে না। তারওপর কে ব্যাংক লুটে নিল, কে রিজার্ভ গোগ্রাসে গিলে ফেলল, কোন মুক্তচিন্তক বা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ উগ্রবাদিদের নিষ্ঠুরতার শিকার হলেন, কোন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রেল লাইনের পাশে মরে পড়ে রইলেন, কোন নারীর সম্ভ্রমে অভিসম্পাত নামিয়ে দিল একদল কাপুরুষ, এসবের বিচারহীনতা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমাদের জন্য বরাদ্দ সময় শেষ হয়ে যায়। সেখানে ভালোমানুষিতার হদিস নেবে কে আছে ভুলোমনা অথবা ভালোমনা এমন?
এবারের ঈদটা সবার জন্যই আলাদা দ্যোতনা নিয়ে এসেছে। চলছে গ্রেট শো অন আর্থ বিশ্বকাপ ফুটবল। আসছে জাতীয় নির্বাচন। কে কোন দিকে তার ভোটের তরি ভিড়াবে এ নিয়ে চলবে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আষাঢ়ে মেঘের সুরভী তার জলজ পবিত্রতায় ভিজিয়ে দিতে পারে প্রকৃতিপ্রেমীর তনুমন। আর রসনা বিলাসে গাছপাড়া ফলফলাদি তো থাকছেই। এতসব বিপুলবিস্তারি আয়োজন নিয়ে বাঙালি জীবনে অনেকদিন ঈদ আসেনি। এবারের ঈদের মৌতাত তাই চৌদিকে ফুলেফলে ভরা।
আমাদের থাকতে পারে ক্রসফায়ার নামের জীবনসংহারি মাদকাভিযান, থাকতে পারে মানবতার দায় মেটাতে গিয়ে আমাদের ওপর চেপে বসা রোহিঙ্গা সংকটের দুর্ভাবনা, তবু আজকের এই আনন্দদিনে আমাদের প্রতীতি এই হোক, সকল ব্যার্থতা গ্লানি ভুলে যাব, নিন্দা, উপহাস বর্জন করব আর বাঙালি হিসেবে যাকিছু অর্জন তাই মাথায় করে রাখব।
আমাদের আরাধনা হবে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সহিষ্ণুতার চরম উৎকর্ষতায় উন্নীত হওয়া। সকল প্রকার বিদ্বেষ ও ঘৃণাবোধকে ঘৃণা করতে শিখব আমরা। কোটি মানুষের মধ্যে কোনো দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থান্ধ খারাপ মানুষও হয় তো গ্রামে ফিরে গিয়ে লোকদেখানো ভালোমানুষিতে মেতে ওঠছে। আমরা তাদের দিকে না তাকিয়ে বরং এটা কেন ভাবি না যে, যেই ফায়ার সার্ভিস কর্মী, শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য, ডাক্তার, সেবাসংস্থা বা গণমাধ্যমকর্মী শুধুমাত্র আপনার আমার নিরাপত্তা ও কাঙ্ক্ষিত সার্ভিস দিতে গিয়ে ঈদে ঘরে ফিরতে পারেননি, তিনি আর যাইহোক খারাপ মানুষ হতে পারেন না।
আমাদের ঈদ আনন্দের মন ও মানসিকতায় সমাজের ত্যাগী মানুষদের মুখশ্রীটাও যেন রাখি। আমরা সবাই নিজে ভালো হলে পৃথিবীতে একজনও খারাপ মানুষ থাকবে না, এই চেতনাটা এবার জাগুক। কেবল গ্রহণ নয় সর্বস্ব ত্যাগে যেন আমরা ব্রতী হই। বিলিয়ে দেয়ার আনন্দে নিজে সুখী হই আর আমার প্রাণের বাংলাদেশটাকে ভালো রাখি। সবার জন্য পবিত্র ঈদ উল ফিতরের প্রাণান্ত শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক। দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুলের চিরায়ত সুর বাজুক সবখানে-
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।।
লেখক: সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন