সড়ক দুর্ঘটনার দায় আমাদেরই
শনিবার থেকে আজ পর্যন্ত পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গাইবান্ধায় একটি নৈশ কোচ রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেলে ১৮ জন নিহত হন। আর রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বিকল বিআরটিসি বাসের পেছনে ধাক্কা দেয় একটি ট্রাক। এতে ছয়জন নিহত হন। এ ছাড়া নাটোর শহরে বালুবোঝাই ট্রাকের ধাক্কায় ২, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জনসহ বিভিন্ন স্থানে পৃথক পৃথক দুর্ঘটনায় মাত্র ১৬ ঘণ্টায় এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সড়ক তো নয় যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদ।
প্রতিবছর ঈদ এলে এ মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষেরা উৎসব করে, আনন্দ করে, দিন শেষে সুস্থ শরীররে ঘরে ফিরে যায়। নতুন উদ্যমে জীবন সংগ্রামে নামে। আমাদের দেশে উৎসব আসে আর সাথে করে নিয়ে আসে মৃত্যুভয়। ঈদের আগেই নানারকম পথে মৃত্যুভয় নিয়ে আমরা আড়ষ্ট ছিলাম। অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। যাক, মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি গিয়েছিলেন মানুষ। কিন্তু ঈদের পরের মৃত্যু অভিযান আর থামানো গেল না।
শনিবার ভোর রাত থেকে বিকেল অবধি প্রায় ৪০ জনের মৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়ী। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হয়তো বলতে পারেন, যে চালক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তাকে তো তারা নিয়োগ দেননি বা শিখিয়ে দেননি। কিন্তু কোনো ধরনের চালকের হাতে গাড়ি থাকলে তা দুর্ঘটনার শিকার হবে না, তা নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের দায়িত্ব। একই সাথে রাস্তায় বেরোনোর আগে গাড়ির ফিটনেস ঠিক অছে কি না তা দেখার দায়িত্বও সরকারি সংস্থার। এ দায়িত্বগুলো বাংলাদেশের এইসব কর্তৃপক্ষেরা কখনোই ঠিকঠাক পালন করেন না।
তারপর আসবে মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনের দায়। বাস মালিকরা একজন মানুষকে যখন চালক হিসেবে নিয়োগ দেন, তখন তার সঠিক প্রশিক্ষণ আছে কি না তা নিশ্চিত করেন না। এটা বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি অনুসন্ধান ও গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। এমনকি ঢাকা শহরের মতো জায়গায় লাইসেন্স না থাকার পরও দিব্বি গাড়ি চালাচ্ছে কয়েক হাজার চালক। এর দায় বিআরটিসির যেমন আছে তেমনি অসাধূ মালিকদেরও আছে। তারা অপেক্ষাকৃত কম টাকায় চালক নিয়োগ দেওয়ার খাতিরে যাকে তাকে গাড়ি বুঝিয়ে দিচ্ছে। চালক কি মাদকাসক্ত নাকি অল্প বয়স্ক নাকি শারীরিকভাবে অসমর্থ, এসব দেখার দরকার মনে করেন না কোনো মালিক। দিন শেষে তাঁর দরকার মুনাফা। অধিক মুনাফার লোভে তাঁরা যা ইচ্ছে তাই করছেন।
যাত্রী সুরক্ষায় একটি শব্দও নেই কোনো শ্রমিক-মালিক সংগঠনের কাছে। তারা ব্যস্ত বরং কোথায় কোন বাস বা ট্রাকচালক বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে- তাকে উদ্ধার করতে।
তারপরও অনেক দায় আছে, সে দায়টা আমাদের জনগণের। আমাদের কী দায়? আমরা সড়ক আইন মানি না, ট্রাফিক আইন মানি না, সচেতন থাকি না। আরো বিভিন্ন রকমের দায় আমাদের আছে।
আমরা কাদের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং তুলে দিচ্ছি? আমরা কি এটা কখনো চিন্তা করি? হোক আমার ভাই, সে গাড়ি চালানোর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়েছে কি না, সঠিক ট্রাফিক জ্ঞান তার আছে কি না, শারীরিক ও মানসিকভাবে সে গাড়ি চালানোর জন্য ফিট কি না, কোন মাত্রার অভিজ্ঞতায় কোন ধরনের গাড়ি সে চালাচ্ছে—এ বিষয়গুলো দেখার দায় তো আমাদের আছে। আমরা কে কতটুকু তা দেখি?
‘সড়কে মৃত্যুর জন্য দায়ীদের ফাঁসি চাই’? বলিনি। কারণ, আমরা সবাই আত্মকেন্দ্রিক। এই সীমাহীন নৈরাজ্যের পেছনে আমাদের তার চেয়েও সীমাহীন নীরবতা কি কোনো অংশে কম দায়ী? আমরা মালিক-চালকদের কারণে দেশের প্রতিটি সড়ক যে একেকটি মৃত্যুপুরি হতে চলেছে তার বিচার চাইতে পারি না। সুতরাং দায়টা আমার আপনার-আমাদের সবার।
সবকিছুর পরও একটি কথা থাকে তা হলো-ব্যবস্থা নেওয়া। আমাদের দেশে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া কোনোকিছুই নিয়ন্ত্রণে আসতে চায় না। তাই প্রথমে আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে সত্যিকার অর্থে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত ব্যবস্থা নিতে হবে মালিকদের বিরুদ্ধে। আইন অনুযায়ী যোগ্য ব্যক্তিকেই চালক নিয়োগ করতে হবে। যেসব মালিক তা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে তৎক্ষনাত মামলা রুজু করতে হবে। অর্থাৎ সড়কে যেই গাড়ির চালককে যথাযথ প্রশিক্ষণের সনদ ছাড়া পাওয়া যাবে, তাকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি সেই গাড়ির মালিককেও গ্রেপ্তার করতে হবে।
এ ছাড়া যে ব্যবস্থাটি বেশি প্রয়োজন তা হলো-চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য পরিবহন মালিকদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। পরিবহনের মালিকরা সবাই যৌথ উদ্যোগ নিলে ভালো প্রশিক্ষিত চালক যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি তাদের নিজেদেরও উপকার হবে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে যাবে। সরকার এই বিষয়টি এখনই চিন্তা করা উচিত এবং মালিকদের ডেকে কীভাবে এই ব্যাপারে তাদের সহায়তা করা যায় সেই চেষ্টা করা উচিত। বড় কথা হলো অনেকের মনে এই সংশয় আছে যে, সরকার এবং মালিকরা আসলে আন্তরিকভাবে এসব কাজে এগিয়ে আসবে কি না, কিংবা তাদের সেই সময় আছে কি না।
লেখক- সাংবাদিক, আরটিভি