অভিমত
পাহাড় কিংবা সমতলে কোথায় নারীর নিরাপত্তা?
যে সবুজ পাহাড় ও স্নিগ্ধ আলোয় আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানে এখন নরখাদকদের বিচরণ। আমি নিজে যেসব জনপদে নিশ্চিন্তে শৈশবে হেসে খেলে বেড়িয়েছি সেখানে এখন নরজন্তুদের অবাধ চলাচল। আমরা কি অপরাধী পরিবেষ্টিত এ রকম পার্বত্য অঞ্চল চেয়েছিলাম? আমরা কি শিশুদের জন্য বীভৎস জগতের স্বপ্ন দেখেছিলাম? প্রকৃতির মায়া আর স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে যে জীবন তা তো সুখ আর স্বস্তিদায়ক হবারই কথা। অথচ কিছু ঘটনা আমাদের মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে; হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি আমরা।
২৮ জুলাইয়ের(২০১৮) ঘটনা আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার নয়মাইল এলাকার ত্রিপুরাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯ বছরের ছাত্রী পূর্ণা ত্রিপুরাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। জন্মের ৫ বছর পর শিশুটির বাবা মারা যায়। পিতৃহীন ছোট্ট শিশুর সেই ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহ আমার বেঁচে থাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দেশব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। পার্বত্য এলাকায় এর আগেও ঘটেছে দুর্বৃত্তদের দ্বারা এ রকম অনেক ঘটনা। কেবল পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশুর জীবনে মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেনি; পরিসংখ্যান বলছে এই পরিস্থিতি আরো বেশি ভয়াবহ। এখন আমি আতঙ্কিত নিজেকে নিয়ে; আমি শঙ্কিত পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত আমার আত্মীয় পরিজনদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। আমাদের কন্যা শিশুদের আমরা কি নরপশুদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারব?
শিশুটি যখন স্কুলে তখন তার মা জুম চাষের কাজে ছিলেন। পাহাড়ের বাস্তবতা হলো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বাস্তবতা, প্রতিদিনের কাজের সংগ্রাম। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার লড়াই। সেখানে শহরের মা-বাবার মতো শিশুর জন্য স্কুলের সামনে বসে থাকার অবকাশ নেই। তাকে আনা-নেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণও নেই। যে এলাকাটিতে শিশুটির জন্ম, যেখানকার সে মৃত্তিকার সন্তান; সেই স্থানীয় অঞ্চলে দুর্বৃত্তের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ারও কারণ নেই। আশ্চর্য হলো সেখানেও অপরাধীদের বিচরণ এখন কদর্যভাবে সত্য হয়ে উঠেছে। ওই শিশুটির মায়ের জুম চাষে যাওয়ার প্রসঙ্গটি আমাকে মনে করিয়ে দিল গত ১৯ মে ২০১৮ সীতাকুন্ড উপজেলার জঙ্গল মহাদেবপুর পাহাড়ের ত্রিপুরাপাড়ায় আদিবাসী দুই কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনা। সেখানেও জুমচাষের জন্য মা-বাবা কিশোরী সুখলতি ও ছবি রানীকে ঘরে রেখে পাহাড়ে চলে যান। বিকেলে নিজ ঘরে ফেরার পর পুনেল ত্রিপুরার বসতঘরের একটি কক্ষে দুই কিশোরীকে ঝুলন্ত ও মৃত অবস্থায় দেখা যায়। জানা যায়, উক্ত ধর্ষিতার একজন সুখলতিকে স্থানীয় চৌধুরী পাড়ার ইসমাইল হোসেনের পুত্র আবুল হোসেন তার বখাটে সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে ত্রিপুরা পল্লিতে গিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। এতে সে অসম্মতি জানালে বখাটে আবুল হোসেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এর আগে অপহরণ ও হত্যার হুমকি দিয়েছিল ওই কুপুত্রটি। পরের ঘটনা নির্মম, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড। আমাদের নারীদের প্রতি সহিংসতার এরকম ঘটনা আরো আছে। আদিবাসী নারী ধর্ষণ নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো জায়গায় নারীরা আর নিরাপদ নয়। চলতি বছর ১৭ জুন বান্দরবানের লামায় নিজ বাসায় ম্যাহ্লাউ মার্মা নামে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা নারীর অসম্মান, মানবতার অসম্মান, পুরো সভ্যতার জন্যই মানহানিকর। খুনের ক্ষমা আছে, ধর্ষণের নেই। কঠোরতম শাস্তি তাকে পেতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন এ কথাই ঘোষণা করেছে।
আদিবাসী জনপদে ধর্ষণকে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি বলে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। কেবল খাগড়াছড়িতে গত ৩ মাসে ৫ কিশোরী ও শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৮) রাঙামাটির বিলাইছড়িতে উনিশ বছরের এক মারমা তরুণী ধর্ষিত হয়েছেন আর তাঁর কিশোরী বোনটি যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৩৬৪ জন আদিবাসী নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। তার মধ্যে ১০৬ জন শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, ১০০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং ৬৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের কেবল জানুয়ারি মাসেই ১০ জন ধর্ষণের শিকার হন তার মধ্যে তিনজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছিল সবিতা চাকমা, সুজাতা চাকমা, ছবি মারমা আর তুমাচিং মারমাকে। আনুবীক্ষণিক দৃষ্টি দিলে দেখা যায় কেবল ২০১৫ সালে পার্বত্য এলাকায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৫ জন নারী ও কন্যাশিশু। তাদের মধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার ২৬ জন, হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে, ১১ জন শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, ধর্ষণের চেষ্টা ১৬ জনকে, পাঁচটি অপহরণ, ছয়টি শারীরিক ও যৌন হয়রানি এবং দুটি পাচারের ঘটনা ঘটেছে। আর উচ্ছেদের হুমকিতে দিন কেটেছে অধিকাংশ পরিবারের। আসলে আদিবাসীরা এখন জাতিগত সহিংসতার শিকার। আমরা জানি জাতিগত নির্মূলের অন্যতম ঘৃণ্য কৌশল হলো নারী ধর্ষণ। যুদ্ধকালে সামরিক কৌশল অনুযায়ী পরিকল্পিত ধর্ষণের ঘৃণ্যতম নজির দেখা গেছে বসনিয়ার যুদ্ধে, সিয়েরা লেওনে, লাইবেরিয়াসহ আফ্রিকার দেশগুলোতে। কমবয়সী বাচ্চা মেয়েদের ধর্ষণ আর যৌন হয়রানির জন্য টার্গেট করা হয় যুদ্ধের ময়দানে। আদিবাসী জীবনে এখন তো আর যুদ্ধ নেই; তবু কেন শিশু হত্যা ও ধর্ষণ চলছে?
গবেষকরা বলে থাকেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণসহ সকল মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করতে হলে তা বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখেই করতে হবে। একসময় গণধর্ষণ, বিশেষ করে কমবয়সি মেয়েদের ধর্ষণসহ অঙ্গচ্ছেদ এবং ধর্ষণপরবর্তী হত্যা ছিল পার্বত্য এলাকার সহিংসতার অন্যতম ইতিহাস। অনলাইন নিউজের সূত্র মতে, কেবল ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ সালেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মাল্যা, লোগাং আর ন্যান্যারচরে তিনটি ম্যাসাকার (গণহত্যা) সংঘটিত হয়। সেসময় ধর্ষিতাদের ৪০ শতাংশই ছিল নাবালিকা, শিশু। ধর্ষিতাকে সমাজ আর পরিবার কলঙ্কিত বলে আর গ্রহণ করে না। তাই গণধর্ষণের ফলে শিশুর জন্মরোধ করার চেষ্টা করা হয়। লোকলজ্জা আর ভয়ের দীর্ঘস্থায়ী এক মানসিক আঘাতে (ট্রমা) আক্রান্ত হয় ধর্ষিতা আর তার পরিবার। স্পষ্টতই এই আক্রমণ আমাদের অস্তিত্ব বিপন্নকরণের নীতি হিসেবে চিহ্নিত। রাজনীতিবিদদের বলতে চাই, পাহাড়ের মাটি চাইলেই হবে না পাহাড়ের মানুষদের গুরুত্ব দিতে হবে। পাহাড়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও ত্রাসের সংস্কৃতি বজায় থাকলে আমরা উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবো। বলাবাহুল্য, কোনো সরকারের আমলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা হামলামুক্ত নিরাপদ জীবন পায়নি।
পূর্ণার ঘটনা প্রমাণ করে, পার্বত্য এলাকায় ধর্ষণ কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পূর্বে উল্লিখিত ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে তাই একে পরিকল্পিত ধর্ষণ বলতে হয়। কেবল পাহাড়ে নয় দেশের সর্বত্র চলছে নারী নিপীড়নের প্রতিযোগিতা। সমীক্ষা বলছে, প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় অন্তত ৯ জন নারী ধর্ষিতা হচ্ছেন বাংলাদেশে। এর মধ্যে কয়টা কেস নথিভুক্ত হচ্ছে? ধর্ষণের অত্যাচার নীরবে সহ্য করাটাই এখন আমাদের সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পাশে কলেজ ছাত্রী তনু ধর্ষণ ও হত্যার কোনো সুরাহা এখনো হয়নি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে ২০১৭ সালের প্রথম ১১ মাসের বিবরণ অনুযায়ী, ধর্ষণসহ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ছিল হাজার ৮৪৪ টি। এর আগের বছর ২০১৬ সালে যা ছিল এক হাজার ৪৫৩টি। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এসব ঘটনা বেড়েছে ২৮৪টি। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ২৯ হাজার ধর্ষণ মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ছয় হাজার মামলার রায় হয়েছে। বাকি মামলাগুলো মীমাংসা হচ্ছে নানা কারণে। এমনকি সালিশ করে ধর্ষিতার সঙ্গে ধর্ষণকারীর বিয়ে দেওয়ার ঘটনাও আমরা জানি। এতে আসামিরা অপকর্মে সাহস পাচ্ছে।
২.
অতীতে আদিবাসী নারী ধর্ষণের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানেও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। পূর্ণা ত্রিপুরার পরিণতি আমাদের জানান দিচ্ছে যে, আদিবাসী জনপদ যদি অপরাধীদের দখলে চলে যায়, তাহলে আমাদের অবাধ বিচরণ ও নিশ্চিন্ত বসবাসের আর জায়গা থাকবে না। প্রায় প্রতি বছরই পাহাড়ি জনপদে হামলা-অগ্নিসংযোগ-ভূমি বেদখলের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণ, জাতিগত হামলা, সামরিক-বেসামরিক বাহিনীর অভিযান, আতঙ্ক ছড়ানো, আর হয়রানি পাহাড়ের নিত্য দিনের ঘটনা। আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ করলেও কোনো বিচার নেই। ধর্ষক, খুনিরা দিব্যি মুক্তি পেয়ে যায়। তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়। আসলে ধর্ষণের মতো বিকৃত কামুকতা সমাজের এক গভীর অসুখ। যখন একজন আদিবাসী বা সংখ্যালঘু নারীর জীবনে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুপরিকল্পিত। কারণ ধর্ষণকারীরা জানে এ ক্ষেত্রে প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করবে। তেমন কোনো সামাজিক প্রতিবাদ হবে না। এজন্য দেখা যায়, মামলা হলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের হুমকিধমকিতে অনেকটাই নিরাপত্তাহীনতায় থাকে তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নানাবিধ সামাজিক সংকটের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে নীতিবোধ আর শৃঙ্খলার অভাবের কারণে ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। অথচ বিশ্বব্যাপী ধর্ষণের শাস্তি রয়েছে। ভারতে শিশু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে চলতি বছর আইন পাস হয়েছে। আমেরিকায় ধর্ষণের অপরাধের শাস্তি ৩০ বছরের কারাদণ্ড। চীনে কোনো ট্রায়াল নেই। মেডিকেল টেস্টের পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। পোলান্ডে হিংস্র বুনো শুয়োরের খাঁচায় ফেলে ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আরবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত পাথর ছুড়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মঙ্গোলিয়ায় ধর্ষিতার পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে কঠোর আইন থাকলেও ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ, অনশন চালাতে হয়। তারপর হয় তদন্ত; কখনো বোঝাপড়ার চেষ্টা চলে। ঘুষ দিয়ে কিংবা ধমক দিয়ে ধর্ষিতার পরিবারকে নাজেহাল করা হয়। ধর্ষিতার পরিবারকে ব্ল্যাকমেল করা একটি নিত্যদিনের কাহিনী আর ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে গবেষণা চলে।
অন্যদিকে ধর্ষণের বিষয়টি মিডিয়ার আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। স্থানীয়ভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়। জামিনে মুক্ত হয়ে ফের ধর্ষণ করে অপরাধী। সিলেটের হবিগঞ্জে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বিউটির জীবনে। বলা হচ্ছে, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই দেশে ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়; যা খুব বিস্ময়ের। প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অসংখ্য অপরাধমূলক ঘটনার কোনোটারই প্রতিকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা করতে পারে না। এজন্য তাদের জবাবদিহি করতে হয় না, কারো চাকরিও যায় না। বরং তাদের দুর্বলতার সুযোগে অপরাধীরা নৃশংস ঘটনা সংঘটিত করার সাহস পাচ্ছে। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জোরদার হওয়াতে অপরাধীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে; তারা যা খুশি তাই করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা কিংবা সামাজিক প্রতিরোধ কোনোটাই জোরদার হচ্ছে না। ফলে দেশটা ক্রমেই অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। এ বাস্তবতার নিরিখে বলতে হয়, ধর্ষিতার পাশে দেশের নারীসমাজসহ সবাইকে দাঁড়াতে হবে। সরকারকে নারী সমাজের নিরাপত্তাসহ সকল সুব্যবস্থা প্রদান করতে হবে। শিশু ধর্ষণ বা হত্যার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য প্রশাসনের প্রতি জোর দাবিও জানাচ্ছি আমি।
৩.
পূর্ণার ঘটনাসহ দেশের সব ধর্ষণ ও হত্যা স্পষ্টত বাংলাদেশের নারীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। এসব ক্ষেত্রে নারী সমাজের মৌলিক অধিকারও লুণ্ঠিত হচ্ছে দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা। অপরাধীদের অপতৎপরতায় আমরা নারীরা ক্রমশই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছি। আমরা না পাচ্ছি সুষ্ঠু বিচার, না পাচ্ছি কারো সহযোগিতার মঙ্গলময় হাত। ক্রমাগত মানসিক যন্ত্রণায় কুঁড়ে কুঁড়ে নিঃশেষ হচ্ছি। আমাদের মানবাধিকার রক্ষার ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে। আমরা নারীরা যেখানেই থাকি যেভাবেই থাকি যে মতের থাকি যে দলেরই থাকি আমরা যদি নিরাপদ থাকি তাহলে বুঝব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নতুবা নয়। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন যদি আদিবাসী মানুষের হত্যার বিচার করতে না পারে, নারী ধর্ষণের বিচার করতে না পারে, আমাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে না পারে; তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায় বলতে পারেন?
আমরা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে এতদিন সুরক্ষিত করে রেখেছি, ঠিক সেখানেই ধর্ষণ হয়েছে আর ধর্ষণ করেছে পাহাড়ে অনুপ্রবেশকারী কিংবা দুর্বৃত্তরা। যৌনহয়রানি, ধর্ষণ করে পুরুষরা। কাজেই এ ব্যাপারে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষদেরই; সংশোধিত হতে হবে আগে তাদের। ধর্ষণের মতো বর্বরতা এবং মানবতাবিরোধি অপরাধের বিরুদ্ধে দেশের সব মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের প্রতিবাদ করা দরকার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা মুক্তি পেতে চাই। এজন্য দেশের শুভবোধ সম্পন্ন সবাইকেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।
৪.
ধর্ষণ মুক্ত সমাজে নারীর জীবনে সুখ, শান্তি আর আনন্দ ফিরিয়ে আনব সম্মিলিত শক্তিতে। পূর্ণার মতো অভাগা পরিবারের পাশে আমরা দাঁড়িয়ে থাকব; তাদের মনোবল জাগিয়ে তুলব। আমরা জুমচাষ করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে চাই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষ আদিবাসী জনগোষ্ঠী শান্তি প্রিয়। পাহাড়ে সবুজ বৃক্ষলতা আর বনে বনে বর্ণিল ফুলের আলোড়ন আমাদের জীবনে প্রশান্তি আনে। সেখানে বিচিত্র পাখি গান গায়, গহীন অরণ্যের হৃদয় ভেদ করে সকালের সূর্য ওঠে। ছড়া আর নদীর ক্ষীণস্রোত জীবনের গান শোনায়। আমরা এই নির্মল প্রকৃতিতে শান্তিতে থাকতে চাই। নির্ভয়ে পথ চলতে চাই। বাতাসের নড়ে ওঠা বৃক্ষের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে চাই। মানুষ তো মানুষের জন্য। অপরাধীদের প্রতিরোধ করার জন্য অসহায় মানুষের পাশে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হবে। মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম আমরা চালিয়ে যাব আজীবন। পূর্ণার মতো কন্যাশিশুরা আর কোনোদিন নৃশংসভাবে খুন হবে না- এই প্রত্যাশা আমার।
লেখক : সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, সিলেট।