ঈদযাত্রা
টিকেটে অদ্ভুতুড়ে ভোগান্তি
আমাদের যাত্রাপথ অনিশ্চিত নয়, তবু রোজ নানা বিড়ম্বনাকে পাশ কাটিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। যেকোনো কল্যাণ রাষ্ট্রেই স্বস্তির যাত্রপথ পাওয়া নাগরিকের অন্যতম অধিকার। আমাদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা যাঁদের, তাঁরা খুব কম সংখ্যকই ট্রেন, বাস বা লঞ্চসহ অন্যান্য গণপরিবহনে ভ্রমণের ঝক্কি-ঝামেলা সামলান। তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছতে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেটের ভরসা করতে হয় না। হয় তাঁদের জন্য রাষ্ট্রীয় গাড়ি থাকে, নয়তো প্রথম শ্রেণির টিকেট আপনাআপনিই তাঁদের ঘরে চলে যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের এই যে ফি বছর টিকেটের জন্য হাহাকার, রোধ-বৃষ্টি-গরমে রাত-দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার অপেক্ষার প্রহর গোনা, তাঁরা চেয়েও দেখেন না। অথচ মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল এই রাষ্ট্রের একজন মালিক খুব সাধারণ প্রান্তিক মানুষও। মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষের অনভিপ্রেত, অনৈতিক ও মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা গ্রহণের ফলে গণমানুষের বঞ্চনার আঁধার কখনই কাটে না।
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দূরদূরান্তে বাস করা কর্মজীবী মানুষ বছরে মাত্র দুবার তাঁদের স্বজনের কাছে ফেরার সুযোগ পান। এক পবিত্র ঈদুল ফিতর এবং দ্বিতীয় উপলক্ষ হলো ঈদুল আজহা। আসছে ঈদুল আজহা উপলক্ষে আজ থেকে বাসের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে গাবতলী বা মহাখালী টিকেট কাউন্টারে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে সবাই টিকেট সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। ৫ আগস্ট টিকেট বিক্রি করার কথা থাকলে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের কারণে টিকেট বিক্রি দুদিন পিছিয়ে গেছে। অদ্ভুত হলেও সত্য যে, এরই মধ্যে ১৬ থেকে ২০ আগস্টের টিকেট নাকি প্রায় শেষ, পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে এমন খবরই দিচ্ছে গণমাধ্যমগুলো। ঈদ যদি ২২ আগস্ট হয়, তবে ২০ তারিখের টিকেটেরই সর্বোচ্চ চাহিদা থাকার কথা। অনুমান করাই যায়, হাজার হাজার মানুষ স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর প্রত্যাশিত টিকেট কিনতে পারবেন না।
আসলে বিশৃঙ্খল সিস্টেম ও অরাজকতার এই দেশে সবকিছুই মেলে খানিকটা ভিন্নপথে এবং অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে। যে টিকেট পাওয়া যাওয়ার কথা টিকেট কাউন্টারে, তা দুদিন পরেই মিলবে কালোবাজারিতে। এবং টিকেটের মূল্য হয়ে যাবে দ্বিগুণ-তিন গুণ। মানুষের আবশ্যিক প্রয়োজনকে পুঁজি করে মুনাফাখোরি বাঙালির ইদানীংকার মারাত্মক বাজে স্বভাব। নাগরিক হিসেবে আমার যা প্রাপ্যতার প্রাধিকার, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তা থেকে বঞ্চিত করাই এখনকার বাস্তবতা। সবই মিলবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অতিরিক্ত ঘাম-শ্রম-সময় ও অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে।
যে ভোগান্তির অস্তিত্ব থাকার কথা নয়, তেমন এক ধরনের অদ্ভুতুড়ে ভোগান্তি সৃষ্টিকারীরা আইনের ফাঁকও ভালো জানে। তারা সব সময় সরকারের কাছাকাছি থাকে। আধিকারিকদের ঈদের শপিং খরচের জোগান দিয়ে ধারালো আইনকে ভোঁতা করবার ফন্দিফিকিরও এরা রপ্ত করেছে অনেক আগেই। অথচ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সদিচ্ছা থাকলে ট্রেনে, বাসে এবং লঞ্চের টিকেট ভোগান্তি অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা যেত।
সরকারের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সদিচ্ছা নিয়েই সংশয় আছে। তিনি ও তাঁর সভাসদরা দেশের সড়ক ও নৌপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু যাত্রী বিড়ম্বনা রোধে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করতে পেরেছেন, এমনটা আমরা দেখিনি। অথচ শুধু তাঁর দলের লোকজনকেও তিনি যদি বলে দিতেন, ঘোরপ্যাঁচে অর্থ আয় নয়, সেবার মানসিকতায় যাত্রী পারাপারের বন্দোবস্ত করতে হবে এটা তাঁর নির্দেশ, তবু দৃশ্যপটের অনেকটা বদল হতে পারত। আমরা জানি, সেটা হবে না। অতএব, প্লেনের টিকেট থাকবে না, ট্রেনের টিকেট শেষ হয়ে যাবে, বাস-লঞ্চের টিকেটের মুখও আমজনতা দেখবে না, এটাই হয়তো এই বঙ্গভূমির ঈদে ঘরমুখো মানুষের বার্ষিক ট্র্যাজিক নিয়তি।
অথচ এই সমস্যাটির কী সহজ সমাধান করা যেত। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে আমরা আত্মতৃপ্তি বোধ করি। নিশ্চিতার্থেই ইন্টারনেট আমাদের গতি ও স্বচ্ছতা এনে দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বাস অথবা ট্রেন তাদের সাকল্য টিকেট সংখ্যা এবং সংগ্রহের বিধিমালা নিজেদের ওয়েব পেজে লিখে রাখলেই মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত টিকেটটি অনলাইনেই পেতে পারত। শুনেছি সেই বিধিও নাকি আছে। কিন্তু অর্থলোভী পাতকের ডিজিটাল ওই পথ ভালো লাগে না। হয়তো সেখানে চোরাকারবারিটা একদমই জমে না। এ জন্য অ্যানালগ সিস্টেমই এখন পর্যন্ত টিকেট ক্রয়-বিক্রয়ের প্রধান ভরসা। তাহলে লাখো মানুষের ভোগান্তির দিনলিপিতে ভর দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প আমরা বুনে যাই কী করে?
অনেক কষ্ট করে দুধের শিশু কোলে নিয়ে দিনভর লাইন পাহারা দেওয়ার পর ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো একখানা টিকেট যদিও বা কপালে জোটে, আবার ভাবনায় দুঃখ জাগায় সড়কের সমূহ বিপদের শঙ্কা। দেশের আকাশপথেও প্লেনের নাটবোল্ট খুলে যেতে দেখা যায়। অন্যদিকে ভাঙা রাস্তা ও যানজট, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই লঞ্চ ডুবে যাওয়ার ভীতি, ৯টার ট্রেন কয়টায় ছাড়া ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়, ইত্যাকার বহুবিধ মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম সংকট থেকে মুক্তির পর তবে ঈদের আনন্দ। আমাদের শাসকরা হয়তো ভেবেই নিয়েছেন, কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না। সড়কপথে, জলপথে অথবা আকাশপথে এত দুঃখ সইবার শোকগাথাই যদি না থাকল, তবে আনন্দ উপলব্ধির আর পূর্ণতা কিসে?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।