পরিবহন ধর্মঘট
আসলে চুনকালি পড়ছে কাদের মুখে?
অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে ফেলে, নজিরবিহীন ধর্মঘট করছে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এই আগুনে আলুপোড়া দেওয়ার মতলব ফেঁদেছেন কারা? যারা মতলব ফেঁদেছে, তারাই বাংলাদেশের মুখে চুনকালি মেখে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ তার পরও তারা সহাস্যবদনে কিছুই জানে না বলে তারা প্রচার করছে। এতটা নির্লজ্জ কীভাবে হতে পারে মানুষ?
মানুষের জরুরি সেবা সংস্থার কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে দাবি আদায়ের ধর্মঘট করার ইতিহাস পৃথিবীর কোথায় আছে? বৈশ্বিক বাস্তবতায় এমন কোনো কঠোর পরিবহন আইন বাংলাদেশে পাস হয়নি যে, যার জন্য এই দেশে শ্রমিক-মালিকদের গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিতে হবে। রাজধানীতে একজন বাস শ্রমিকের কন্যা ও তাঁর সহপাঠী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে শিশু-কিশোরদের বিস্ময়কর বিপ্লবের পর সরকার নতুন পরিবহন আইন করেছে। যে আইনটি অনেক দিন ধরেই ঝুলে ছিল।
সম্প্রতি সংসদে সবার ভোটে পাস হওয়া এই সড়ক পরিবহন আইনে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ খুন করার ক্ষেত্রে কয়েক বছরের জেল বা জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখন এ আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনসহ আট দফা দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। সড়ক পরিবহন আইনের সব ধারা জামিনযোগ্য করা, সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় সাজার পরিমাণ কমানো, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি করার কথা বলছেন শ্রমিকরা।
এই সরকারের যেহেতু সময় শেষ এবং সংসদও আর বসবে না, খুব স্বাভাবিকভাবেই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে বলে দিয়েছেন, ‘এ মুহূর্তে আইন পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ নেই। এ মুহূর্তে পরিবর্তন করতে পারবও না। পরবর্তী পার্লামেন্ট পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে কোনো ন্যায়সংগত বিষয় থাকলে পরে আলোচনার মাধ্যমে বিবেচনা করা হবে।’
সরকারের আরেকজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী, পরিবহন শ্রমিকদের নেতা শাজাহান খান কি এই বাস্তবতা জানেন না? অথবা তাঁর কি জানা উচিত না? অথচ নির্বিকার তিনি মিডিয়ায় উত্তর দিয়ে দিয়েছেন, তিনি কিছুই জানেন না! পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যিনি কার্যকরী সভাপতি তিনি জানেন না, শ্রমিকরা গাড়ি তো বন্ধ রেখেছেনই, উপরন্তু সাধারণ মানুষকে মুখে কালি মেখে কী ভয়ংকর হেনস্তা করছে। মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ আকাশ ছুঁয়েছে। কলেজগামী শিক্ষার্থী, কার্যক্ষেত্রে গমনকারী নানা পেশাজীবী সাধারণ মানুষ এবং জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য হাসপাতালের পথে রোগীরা কী ভয়াবহ বিপর্যয়কর একটা সময় পার করছেন। দুর্মূল্যের রিকশাভ্যান পর্যন্ত না পেয়ে মানুষকে চড়ে বসতে হচ্ছে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার গাড়িতে পর্যন্ত। আর কত কষ্ট দিলে পরিবহন নৈরাজ্যকারীদের বিবেক ফিরবে? তাদের অন্তরে বোধ ফিরবে?
এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় জোরজবরদস্তিতে থেমে যাওয়া শিশু-কিশোরদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ বিপ্লব যদি প্রতিবিপ্লব হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়, তারা যদি প্রতিবাদমুখর হয়, তাদের ধৈর্যের বাঁধ যদি ভেঙে যায়, পালাবার জায়গা পাবেন তো স্বেচ্ছাচারী পরিবহন শ্রমিক-মালিক ও তাঁদের নির্বোধ প্রভুরা?
শাজাহান খান সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী। যার অঙ্গুলিহেলন ছাড়া পরিবহন সেক্টরের পিপীলিকাও নড়ে না, এটা সবাই জানে। সরকারের এই শেষ সময়ে এসে তাঁর নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান সড়কে নির্বিঘ্নে মানুষ খুন করবার লাইসেন্সের দাবিতে ধর্মঘটের নামে যখন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, তখন গোয়ান্দা সংস্থার খোঁজা উচিত এর ভেতরে আসলে কী বদমতলব আছে? কী রহস্য লুকিয়ে আছে?
ধর্মঘটের ভণ্ডামি ও মানুষের মুখে-পোশাকে কালি মাখানোর মতো অপকর্ম ছেড়ে মালিক-শ্রমিকদের উচিত নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। যেনতেনরূপে রাস্তায় মাফিয়াগিরি করে অর্থ উপার্জনই শেষ কথা নয়। সেবার ধর্ম আয়ত্ত না করতে পারলে আপনাদের উচিত এই দস্যুবৃত্তি থেকে সরে আসা। মানুষ অভ্যাসের দাস। আপনাদের মতো ধর্মঘটীদের গাড়ি না থাকলে মানুষ হেঁটে চলাচল করবে, প্রয়োজনে সড়কে খাল কেটে নৌকায় করে যাতায়াত করবে, তবু অন্যায় ও অন্যায্যতার কাছে মাথা নোয়ানো উচিত হবে না। সরকারের তো সক্ষমতা আছে। গণপরিবহনের ব্যবস্থা করে তারা কি জনমানুষের পক্ষের কল্যাণকামী সরকার হয়ে উঠতে পারে না? বিপাকে পড়া মানুষের দুর্দিনের কাণ্ডারি হতে পারে না?
জনতার করে বহুমূল্য ব্যয়ে নির্মিত আমাদের রাস্তাকে গুটিকয়েক পরিবহন-মাফিয়া নরক করে তুলেছে। কাহাতক আর এত কষ্ট নেওয়া যায়? বাগাড়ম্বরের রাজপথ কেন হবে না নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক জনপথ? পীড়াদায়ক রাস্তা রেখে উন্নত জাতি হওয়ার স্বপন আমরা দেখি কী করে? সহ্য নামক যে অনুভূতি আছে তারও তো একটা পর্যায় পর্যন্ত সীমা থাকা উচিত। মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অনাহূত কষ্টরা অভিশাপ হয়ে ঝরুক দুর্বিপাক সৃষ্টিকারী নির্বোধ রথী-মহারথীদের গায়।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছেন ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’! আর মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলে গেছেন, ‘এই পৃথিবী কখনো খারাপ মানুষের খারাপ কর্মের জন্য ধ্বংস হবে না। যারা খারাপ মানুষের খারাপ কর্ম দেখেও কিছু করে না তাদের জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে’! আমাদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়ে সভ্যতা ও ভব্যতার ঘরে আঁধার নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে যারা, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কি জাগব না, প্রতিবাদরমুখর হবো না?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।