অভিমত
৫৭ ধারার প্রত্যাবর্তন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে?
২০১৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারা সন্নিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে তা বাতিলের দাবি উঠেছিল। মূলত মুক্তচিন্তা এবং বাকস্বাধীনতার অধিকার খর্বের ভয় থেকেই তা বাতিলের দাবি তোলা হয়েছিল। সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের গ্রেপ্তারসহ আরো বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা বাস্তবিক ভিত্তি পেতে থাকে।
একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত ক্রমবর্ধমান এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ অপরাধ দমনে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন পুরোপুরি যথার্থ কি না, সে বিষয়েও আলোচনা চলতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন বিবেচনায় সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সর্বোপরি তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধের নিয়ন্ত্রণ এবং শাস্তির বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় সরকার এ-সংক্রান্ত নতুন একটি আইন প্রণয়নের কাজে হাত দেয় এবং সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তারিখে জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাস হয়, যা অভিহিত হয়েছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ নামে।
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’-এর ৬২ নম্বর ধারায় সুস্পষ্টভাবে ডিজিটাল আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের যথাক্রমে ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ নম্বর ধারাগুলো বিলুপ্ত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ এই আইন পাস হওয়ার পরে বহুল আলোচিত ৫৭ ধারা আর কার্যকর থাকছে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু ধারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিতর্কিত ৫৭ ধারাটিকেই প্রতিস্থাপন করেছে। এমনকি নতুন এই আইনে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার আরো বেশি খর্ব হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ কথা ঠিক, দেশে সাইবার, ডিজিটাল অপরাধ দমনে সুস্পষ্ট আইন থাকা দরকার এবং তা এই মুহূর্তেই প্রয়োজন। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ-সংক্রান্ত আইনের আবশ্যিকতা নিয়ে অবশ্য নেতিবাচক আলোচনাও নেই। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় যাতে আন্তর্জাতিকভাবে এবং সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সেটিও নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ, অতিমাত্রায় নজরদারির কারণে আইনটি ভীতিকর হয়ে উঠলে যেমন তথ্যপ্রযুক্তির স্বাভাবিক ব্যবহার ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে, তেমনিভাবে গণমাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে সাংবাদিকরা জেল-জরিমানার খড়গ নিয়ে স্বাধীন এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালাতে যথেষ্ট বেগ পাবেন। আইনটিতে বর্ণিত অনেকগুলো ডিজিটাল কার্যক্রমকে যেমন ক্রিমিনালাইজড (শাস্তিযোগ্য অপরাধ) বিবেচনা করা যথার্থ হয়েছে, তেমনিভাবে কিছু কিছু কার্যক্রমকে সরাসরি ক্রিমিনালাইজড (শাস্তিযোগ্য অপরাধ) আখ্যায়িত না করে বিকল্প উপায়ে সমাধানের পদ্ধতি গ্রহণ করার বিধান রাখলে আইনটির গ্রহণযোগ্যতা এবং কার্যকারিতা আরো বৃদ্ধি পেত ।
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ নতুন কলেবরে তৈরীকৃত আইন। এর ব্যাপ্তি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের চেয়ে অনেক বেশি। নতুন আইনে সাইবার কিংবা ডিজিটাল জগতে সংঘটিত অপরাধগুলোকে একত্র করে একটি পরিপূর্ণ আইন প্রস্তুতের প্রয়াস রয়েছে। কিন্তু যে কারণে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (সংশোধিত) ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি জোরদার হয়েছিল, সে কারণগুলোর উপস্থিতি নতুন আইনেও দেখা যাচ্ছে। নতুন আইনের চারটি ধারায় খণ্ডিতভাবে বিতর্কিত ৫৭ ধারাটিকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ৫৭ ধারায় অপরাধের উপাদান ছিল যথাক্রমে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, মানহানি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো সংক্রান্ত অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ নম্বর ধারায়ও যথাক্রমে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা উসকানি, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো অপরাধকে নতুনরূপে সন্নিবেশ করানো হয়েছে। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ৫৭ ধারার ব্যবহারিক অপপ্রয়োগ এবং অপরাধের উপাদানসমূহের সুনির্দিষ্টতার অভাবে হয়রানির যে ভীতি সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল, নতুন আইনে আপাতদৃষ্টে তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে নতুন আইনের প্রয়োগ এবং ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিয়েছে ।
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে সংবাদমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের। সে কারণে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা সুরক্ষার লক্ষ্যে আইনটির যথাক্রমে ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ এবং ৫৩ ধারার যথাযথ সংশোধন চেয়েছে বাংলাদেশের পত্রিকা সম্পাদকদের সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ অক্টোবর ২০১৮ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন এবং সংসদের আগামী অধিবেশনেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনী আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এরই মধ্যে সম্পাদক পরিষদ ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ তারিখে জাতীয় প্রেসক্লাব সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের লিখিত বিবৃতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে যথাক্রমে ১. সংবিধানের ৩৯ (২)(ক) ও (খ) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহের পরিপন্থী; ২. আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী; ৩. আমাদের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী; ৪. নৈতিক ও স্বাধীন সাংবাদিকতার মৌলিক মূল্যবোধগুলোর পরিপন্থী; এবং ৫. তথ্য অধিকার আইনের চেতনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন।
আইনটির ৮ ধারায় সংগত মনে করলে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত কিংবা প্রচারিত যেকোনো তথ্য-উপাত্ত অপসারণ কিংবা ক্ষেত্রমতে ব্লক করবার বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালালে কিংবা তাতে মদদ প্রদান করলে অভিযোগ গঠন এবং শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এই আইনের ২১ ধারায়। আইনের ২৫ ধারায় আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও তার শাস্তির বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার, ইত্যাদি বিষয়ের অপরাধের বিধান রয়েছে ২৮ ধারায়। তা ছাড়া মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার ইত্যাদি অপরাধের বিচার হবে ২৯ ধারায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে কিংবা অবনতি ঘটবার উপক্রম হয় এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচারকে এই আইনের ৩১ ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ বর্ণনা করে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কোনো ধরনের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তা এই আইনের ৩২ ধারায় কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ আইনের ৪৩ ধারায় পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে পুলিশকে।
উপরোক্ত ধারাগুলোকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কিংবা মুক্ত সাংবাদিকতার প্রশ্নে ‘সম্পাদক পরিষদ’ সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। এর বাইরেও, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের যুগে ব্যক্তিগত, সামাজিক, ব্যবসায়িক, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের ব্যবহারকারীরাও নতুন আইনের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার ভেতর পড়েছেন। আইনটির ১৮, ১৯ ও ২০ ধারায় কম্পিউটার কিংবা ডিজিটাল ডিভাইসে বেআইনি প্রবেশ, ক্ষতিসাধন এবং সোর্স কোড পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধ ও সেগুলোর দণ্ডের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক প্রতারণা, পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ এবং আইনগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে অপর কোনো ব্যক্তির পরিচিতি সংগ্রহ, বিক্রয় দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার সংক্রান্ত অপরাধসমূহকে এই আইনের যথাক্রমে ২৩, ২৪ ও ২৬ ধারায় অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে। নতুন আইনের ২৭, ৩০ এবং ৩৪ ধারায় সাইবার সন্ত্রাসী সংঘটন, আইনানুগ কর্তৃত্ব বহির্ভূত ই-ট্রানজেকশন এবং হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের উল্লেখ রয়েছে ।
এখন দেখা যাচ্ছে, নতুন আইনের উল্লেখিত ধারাগুলোতে বর্ণিত অপরাধসমূহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। সে কারণে এসবের অপব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে খুব বেশি দিন হয়নি। এ ছাড়া ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী ভেদে ব্যবহারের রকম-প্রকৃতি এই পর্যায়ে কিছুটা ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার, প্রয়োগ এবং ডিজিটাল কার্যক্রমের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কেও সকল স্তরে সচেতনতা আসতে আরো সময়ের প্রয়োজন। এ ছাড়া নতুন আইনে মামলার বিচারিক কার্যক্রম ও অনুষঙ্গিক বিষয়াদি পরিচালনার জন্য কী পদ্ধতির ব্যবহার করা হবে, তাও সুস্পষ্ট নয়। যদিও ডিজিটাল আইনের ৫১ ধারায় ভিন্নরূপ কিছু না থাকলে, ফৌজদারি কার্যবিধি প্রয়োগের বিধান রাখা হয়েছে, তথাপি বিশেষ এ আইনের লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ নাও হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকারীদের ভেতর স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে তাই আইনটির সহজপাঠ্য এবং ব্যাখ্যাসংবলিত একটি বিধিমালা অনতিবিলম্বে প্রণয়ন করা আবশ্যক। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল’ এবং ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি’ গঠনের যে কথা বলা হয়েছে, তার যথাযথ গঠন নিঃসন্দেহে এই স্পর্শকাতর আইনের কার্যক্রমকে গঠনমূলক প্রক্রিয়ায় গতিশীল করতে সহায়তা করবে।
নতুন ডিজিটাল আইনে পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালানোর ক্ষেত্রে যেকোনো বিষয়বস্তু আটকে দেওয়ার এখতিয়ার রাখা হয়েছে, যা মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চায় হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। কেননা, প্রাথমিক প্রমাণ নিশ্চিত না করে কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা আটকে দিলে বা জব্দ করা হলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিরুৎসাহিত হবে এবং দৈনিক পত্রিকার প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। আবার সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের কোনো পরোয়ানা ছাড়া ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া যেকোনো মুহূর্তে আটকের বা গ্রেপ্তারের চর্চা আরম্ভ হলে তা হবে সংবাদমাধ্যমের জন্য মর্যাদাহানিকর এবং মানবাধিকারের নীতিমালা বিরোধী। কেননা, সংবাদ প্রকাশ কিংবা প্রচারের পরে কোন অভিযোগ উত্থাপিত হলে, অনেক সময় যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে কিংবা যথোপযুক্ত সংশোধনী প্রকাশের মাধ্যমে তা নিরসন সম্ভব। সে কারণে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদানে সামর্থ্য হলে, জব্দ, গ্রেপ্তার কিংবা মামলা দায়েরের বিষয়গুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এ ছাড়া সংবাদমাধ্যমের কোনো পেশাজীবী দ্বারা সংঘটিত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না, তার প্রাথমিক তদন্ত প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে করা যেতে পারে যেমনটি আইনজীবীদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল করে থাকে।
অন্যদিকে, তথ্য অধিকার আইনে নাগরিক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য যেসব স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেগুলোর সুরক্ষা অত্যাবশ্যক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু ধারা তথ্য অধিকার আইনে প্রদেয় অধিকারকে খর্ব করতে পারে। আইনটির ৩২ ধারায় বলা আছে ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গ করা হলে ১৪ বছরের সাজা। এখন সরকারি গোপনীয়তার সংজ্ঞা ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩’ হতে জানা গেলেও, নতুন আইনে এই অপরাধের ব্যাপ্তি অনেক বিশাল হওয়ার কারণে, এ সংক্রান্ত ধারণাটি সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার অফিশিয়ালি যা কিছু জনগণকে জানাচ্ছে না বা জানাবে না, সেটাই তো গোপন থেকে যাচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী সেটা তো জনগণের জানার অধিকার থাকছে না। কিন্তু সাংবাদিকদের তো সেটা জানা এবং অনুসন্ধান করাই কাজ। এই গোপনীয়তার কারণে তাই তথ্য অধিকারপ্রাপ্তির পথ সংকোচিত হতে পারে এবং বিভিন্ন সরকারি কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে ।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ এ যদিও বর্ণিত অপরাধগুলোকে শ্রেণিবিন্যাস করে জামিন যোগ্য এবং অ-জামিনযোগ্যর তালিকা করা হয়েছে, কিন্তু উদ্বেগ তৈরিকারী প্রায় সব ধারার অপরাধকেই অ-জামিনযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এসব ধারায় কাউকে গ্রেফতার করলে জামিন সহজে হবে না। তাই, নিপীড়ন এবং বিনা অপরাধে কারাভোগের সম্ভাবনার ভীতি থেকেই যাচ্ছে।
সংবাদমাধ্যম ও ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অন্যতম অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্র আইন অনুযায়ী জনগণের বাকস্বাধীনতার সুযোগ নিশ্চিত করবে এটাই কাম্য। জনগণের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী ও আপাত হয়রানিমূলক যেকোনো আইন তাই সংশোধনের দাবি রাখে। ক্রমবর্ধমান এবং নিত্যনতুন সাইবার ও ডিজিটাল অপরাধ মোকাবিলায় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ যেমন সময়োপযোগী এবং কার্যকরী হিসেবে আশার সঞ্চার করেছে, তেমনিভাবে এর বিভিন্ন ধারা নিয়ে বিতর্কের ও হতাশারও শেষ নেই। সর্বোপরি, যে ৫৭ ধারার অপব্যবহার নিয়ে এত বিতর্ক, সমালোচনা এবং অধিকার হারানোর ভয়, সেই ৫৭ ধারা বিলুপ্তির পরও যখন একই রূপে প্রতিস্থাপিত হয় তখন হতাশার আর শেষ থাকে না।
লেখক : ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সিনেট সদস্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ।