রাজনীতি
সংলাপে কি ‘উইন-উইন’ অবস্থা সৃষ্টি হবে?
গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের যাত্রার সময় থেকে প্রায় প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনে সংলাপ বা আলোচনার আয়োজন দেখা গেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আজ সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এ সংলাপে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ২৩ নেতা এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে ১৬ জন অংশ নেবেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দল হলো বিএনপি। আর সরকারের মূল চিন্তার জায়গাটিও বিএনপিকে ঘিরে। নব্বই-পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে থেকেছে। কোনো বিষয়েই উভয় দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। বর্তমান অবস্থাতে পৌঁছাবে কি-না, সেটি নিয়েও যথেষ্ট দ্বিধা রয়েছে। সব সময়ই সরকারি দল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখতে চায়। এবারও এর ব্যতিক্রম আশা করা অমূলক হবে। কাজেই আজকের সংলাপে জাতীয় ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে থেকে যতই উচ্চবাচ্য থাকুক না কেন, মূলত নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়েই তাদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে হবে।
নানা কারণে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আজকের এই সংলাপের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের প্রস্তুতির মধ্যেও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক কর্মসূচিতে বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া সংলাপ সফল হবে না। কিন্তু সংলাপের ঠিক আগ মুহূর্তে এ ধরনের শর্ত কিংবা হুমকি সংলাপ সফল হওয়ার সুযোগকে অনেকটা সংকুচিত করে। বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা থাকবেন নাকি অন্য কেউ হবেন—এমন প্রশ্নের উত্তর আজকের সংলাপ থেকে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে দেশবাসী।
রাজনীতির গতি দেখে মনে হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের ব্যবস্থা করা হলেও এ বিষয়টিকে ঐক্যফ্রন্টের অনেক নেতা ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। মূলত আস্থাহীন রাজনীতির বলয় থেকে বের হতে না পারার কারণেই এটি ঘটছে। তবে এ কথা ঠিক যে, আলোচনাকে সফল করে তুলতে হলে উভয় পক্ষকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। মূলত অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজনীতিকে বিদায় জানাতে হলে এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক যাত্রাকে মসৃণ করার লক্ষ্যে উভয় পক্ষের পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের সুযোগ রাখতে হবে।
রাজনীতির ব্যাকরণ অনুযায়ীই সরকার চাইবে বিরোধীদের চাপে রাখতে, আর বিরোধীরাও সরকারকে চাপে রাখতে কৌশল ঠিক করবে। আবার ওইসব কৌশলকে মোকাবিলা করার জন্য উভয় জোটকেই ইতিবাচক থাকতে হবে। আজকের সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা প্রাসঙ্গিক হলেও মূল বিষয় হলো শেষমেশ শেখ হাসিনাকে প্রধান রেখেই নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়ার প্রশ্ন। সাত দফা দাবির কয়েকটি সহজেও মেনে নেওয়ার মতো রয়েছে। আবার সংবিধান সংশোধন করেও বেশ কিছু শর্ত মানার সুযোগ রয়েছে। এ কারণে আজকের সংলাপে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নটি খুব জোরালোভাবে আলোচনায় আসতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় এর আগে প্রকাশ্যে নেতিবাচক থাকলেও তফসিলের আগে সংলাপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এতে ক্ষমতাসীন মহলের দুই ধরনের লাভ লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রথমত, নির্বাচন সামনে রেখে সৃষ্ট গুমোট পরিস্থিতি কিছুটা দূর হবে এবং বিরোধী জোটের আন্দোলনও অনেকটা দমে যাবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও সংলাপকে কেন্দ্র করে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছবে।
আওয়ামী লীগের ধারণা, মুখে এখন যাই বলুক না কেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো বিএনপি আগামী নির্বাচন বর্জন করবে না। রাজনৈতিক বাস্তবতা, দল ও নেতৃত্বের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং দেশি-বিদেশি উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। আগেরবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশবাসীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল, আর যাই হোক, এর পুনরাবৃত্তি কেউ চায় না। নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হবে কি না, জানি না। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সব দলের ঐকমত্য আগে থেকেই নির্ধারিত হওয়া দরকার। বিএনপির প্রথম কথা হচ্ছে, তারা নির্বাচন করতে চায়। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়, নিরপেক্ষ সরকার হতে হবে।
মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা শাশ্বত, গণতন্ত্রের লড়াই ন্যায়সংগত। এই স্লোগান মাথায় রেখে উভয় পক্ষের যার যার অবস্থানে সঠিক সিদ্ধান্ত জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর সামনে বিতর্কের ঊর্ধ্বে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে বিরোধীদের যেকোনো মূল্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার মধ্য দিয়ে ‘উইন-উইন’ অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে উভয় দলেরই ক্ষমতায় আসতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জোর তৎপরতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা আছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। এটি প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানেন। আর এ জন্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে যত ধরনের কৌশল গ্রহণ করা যায়, সরকার হয়তো তাই প্রয়োগ করবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।