অভিমত
নির্বাচনী রাজনীতিতে আস্থা সৃষ্টি কি সম্ভব?
নানা জল্পনা কল্পনার অবসান শেষে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পর পরই আনুষ্ঠানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে জোরেসোরে নির্বাচনের আয়োজন শুরু হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বের জের থেকে প্রতিটি মুহূর্তই এক ধরনের উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে।
ইতিবাচক রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার প্রেক্ষিতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো স্থিতিশীল যে রাজনৈতিক আচরণের সূত্রপাত ঘটিয়েছে তা দেশের রাজনীতিতে স্থায়ী রূপ লাভ করা-না-করার প্রশ্নটি এখন সবার। আমরা লক্ষ করেছি, বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের শেষ সময়ে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন প্রশ্নে সংকট, শঙ্কা এবং উৎকণ্ঠা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়। বিশেষ করে ৯০ পরবর্তী প্রায় প্রতিটি সরকার শেষেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দেশে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। কখনো সংকট থেকে সুষ্ঠুভাবে উত্তরণ ঘটেছে আবার কখনো রাজনৈতিক ঘোলাটে পরিবেশ জাতির জন্য চরম দুর্ভোগের পরিবেশ তৈরি করেছে। কিন্তু সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আপাত দৃষ্টিতে আগের যেকোনো নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির চেয়ে কিছুটা ভালো বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
কিন্তু এই পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা আদৌ ঘটবে কি না সেই চিন্তাটিও আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। আমরা বিভিন্ন সময়ই লক্ষ করেছি রাজনীতিবিদরা তাদের প্রদত্ত গণতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকার করা হয় কিন্তু গণতন্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোনোটাই রক্ষিত হয় না। আসন্ন নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি চান, বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুনঃপ্রবর্তন ঘটুক।
প্রধানমন্ত্রীর এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রসম্মত অঙ্গীকারের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধরে রাখতে যথাযথ রাজনৈতিক সংসদীয় কৃষ্টির প্রতি আস্থা স্থাপন প্রয়োজন। লক্ষ রাখতে হবে, রাজনৈতিক বিরোধিতার জের ধরে বিরোধী দলের নেতার নামে প্লেট চুরির মামলা কিংবা ককটেল ফাটানোর মামলায় দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতাকে কারাগারে বন্দি প্রভৃতির নমুনা যেন সৃষ্টি না হয়। যে দলই ক্ষমতায় আসুক তাদের একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, বিরোধী দলও সাংবিধানিক মর্যাদা পায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সরকারি ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিরোধী দলের যথাযথ মান রাখতে চায় না। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্বের প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়। কাজেই তারা আজ যে সমঝোতা এবং প্রতিশ্রুতি দিবে তা আগামী দিনেও যথাযথভাবে মেনে না চললে রাজনীতিতে আস্থার সংকট ঘটতেই থাকবে। বিগত সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তা রক্ষায় তাদের সফলতার পরিমাণ খুবই কম লক্ষ করা গেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে লক্ষণীয় বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলো যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। যেভাবে একজন বিত্তশালী ব্যক্তি হাট কিংবা বাজার ইজারা নিয়ে থাকে সেভাবেই দেশের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। একজন বিত্তশালী ব্যক্তি হাট বা বাজার ইজারা নেন এ জন্য যে, কয়েক বছর পর সেখান থেকে তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করবেন এবং লাভবান হবেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিটি নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নির্বাচিত হয়ে সেই টাকা তুলতে অনেকটাই সচেষ্ট হন। অর্থ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হওয়া বর্তমানে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনে ৪০ লাখ টাকা খরচ করলে নির্বাচিত হওয়ার পর তা কীভাবে দ্বিগুণ করা যায় সেদিকটাও খেয়াল রাখে। কাজেই নির্বাচনে মনোয়ন পাওয়া এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হাট বা বাজার ইজারা নিয়ে ব্যবসা করার সামিলই বটে।
প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতা এবং পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে পুনরায় ক্ষমতা ধরে রাখার নতুন ফন্দি করতে সচেষ্ট না হয়ে গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার দিকে সচেতন হতে হবে। এজন্য শুধু নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার নয় বরং নির্বচন-পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে তা মেনে চলার ইতিবাচক অঙ্গীকার রক্ষা জরুরি।
বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব জনগণ, সরকার এবং বিরোধী দলের। আর এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে হবে। কোনোভাবেই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতাকে তুঙ্গে তুলে সহিংসতা ও ভাঙচুর করে অগণতান্ত্রিক কোনো পন্থায় সরকার পরিবর্তনের প্রয়াস চালানো কাম্য হবে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সংঘাত, বলা যায় অসুস্থ অগণতান্ত্রিক সংঘাত, শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার বারবার গণতন্ত্রকে যেন আঁকড়ে না ধরতে পারে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দৃষ্টান্ত তৈরি হলে ভবিষ্যতে অন্তত নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে টানাপড়েনের রাজনীতি বন্ধ হবে। তবে সেক্ষেত্রে সব দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবে এমন মানসিকতা এবং সেটি মেনে নেওয়ার প্রবণতা ভিত্তিতে এবং একটি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে নতুন রাজনীতির ধারা সঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়