অভিমত
উন্নয়নের ভিত্তি কী হবে?
সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা আজকের বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থেই ‘র্যাডিক্যাল’ প্রস্তাব। র্যাডিক্যাল কারণ চলমান বাস্তবতায় এগুলো ১৮০ ডিগ্রি উল্টো স্বপ্ন। অথচ আজ থেকে প্রায় সাতচল্লিশ বছর আগে প্রধানত এই তিন চেতনার প্রতি নিখাদ আস্থা রেখে জীবন দিয়েছিলেন ত্রিশ লাখ দেশপ্রেমিক। সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন চার লাখেরও বেশি নারী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে জন্মক্ষণে দাঁড়িয়ে একটি দেশের জন্য যা বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা ছিল, ২০১৮ সালে তা খুব ইউটোপিয়ান হয়ে উঠল! কেন এমন হলো?
এককথায় উত্তর দিতে গেলে ফরাসি উপনিবেশ, মার্তিনিকে জন্ম নেওয়া প্রখ্যাত সাহিত্যিক, মনোচিকিৎসক ও বিপ্লবী ফ্রাঞ্জ ফানোঁর বিবেচনাকে সামনে আনাটাই প্রাসঙ্গিক হবে। তিনি বলেন, ‘যে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের হাত ধরে একসময়ের উপনিবেশিত রাষ্ট্রগুলো স্বাধীন হলো, সেই নেতৃবৃন্দ দূরদৃষ্টি নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ পরিচালনায় একেবারে সক্ষম নন। তারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অলস বলে সক্ষম হতেও চান না। আর নতুন রাষ্ট্রে ঐ মানুষগুলোই হয়ে উঠলেন অনগ্রসর জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির অংশ।’ যোগ্যতা আর অঙ্গীকারের অভাবে তারা ঔপনিবেশিক মাতৃরাষ্ট্রের উন্নয়ন মডেলসহ সবকিছুই অনুকরণ করতে শুরু করলেন। শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্রের ধরন বা ফ্লাইওভারের নকশা পর্যন্ত তারা নকল করছেন ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র থেকে। আর করবেনই বা না কেন? নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং জাতীয় আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে একটি নতুন রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো করে তারা তো যোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি।
সুদীর্ঘ পাঁচ দশকেও এখানে জাতীয় অর্থনীতি বিকশিত হয়নি। পুঁজিবাদের নামে স্বাধীন বাংলাদেশে যা চলমান, সেটিকে বিশেষভাবে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বলা যায়। অথবা বলা যায় রেন্ট-সেকিং ইকোনমি কিংবা তোলা-ওঠানো অর্থনীতি। এখানে জাতীয় আয়ে সদর্পে উপস্থিত তুলনাহীন বিকাশমান এবং প্রবল প্রভাবশালী যে ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে, সেই শ্রেণির সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে অন্যের এবং প্রকৃতির সম্পদ জবরদখল, বেদখল, তছরুপ বা লুণ্ঠনের মাধ্যমে। ব্যাংক লুট, নদী দখল, বন বিক্রি, ঘুষ-দুর্নীতির মহামারি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি যেন এখানে মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করানোর মতো জাতীয় কোনো শিল্পপণ্যের ব্র্যান্ড তৈরি করা যায়নি।
অন্যদিকে, এখনকার পোশাকশিল্প আর শ্রম রপ্তানিকে এক অর্থে ফরমায়েশি অর্থনীতির চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করেন অর্থনীতির অনেক পণ্ডিত। ফরমায়েশি অর্থনীতি তো নিজের কোমরে ভর দিয়ে দাঁড়ায় না। সে অন্যের হুকুম তামিল করার মধ্য দিয়ে টিকে থাকার পথ খোঁজে মাত্র। সেটি হতে হলো কারণ রাজনৈতিক অর্থনীতির নির্ধারকরা এক্ষেত্রে খুব একটা যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হলেন না।
আর এই সক্ষমতা তো তৈরি হওয়ার কথা ছিল শিক্ষার দৃঢ় ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে। গত কয়েক দশকে আমরা কি কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাভূমি তৈরি করতে পেরেছি? প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো সচেতনায়নের জ্ঞান নিশ্চিত করা। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের পশ্চাদপদ জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি এটিকে আবার খুব বেশি সন্দেহের চোখে দেখেন। বলা যায়, ভয় পান। তারা মনে করেন, সচেতনায়নের শিক্ষার ফলে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে। এবং চলমান নিপীড়নমূলক সমাজ কাঠামো বদলে দিতে চেষ্টা করবে। যদি নয়াশিক্ষিত এই সচেতন শ্রেণি এগিয়ে আসে তবে রেন্ট-সেকিং রাজনৈতিক অর্থনীতি থেকে সুবিধা নেওয়া জাতীয় দুস্থ-বুর্জোয়াদের ক্ষমতাচ্যুত হতে হবে। সে জন্যই বাংলাদেশে হয়তো ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ব্যাংকিং পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত হলো। সেটি এখন ক্রমাগত বিস্তার লাভ করছে বলা যায়। সেখানে প্রকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ঢের বেশি। এ ব্যবস্থায় শিক্ষকবৃন্দ তথ্য ও তত্ত্ব জমা রাখেন শিক্ষার্থীদের মগজে। আর সেই জমাকৃত জ্ঞান আত্মস্থ না করে ছাত্রছাত্রীরা চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে পরীক্ষার খাতায় দিয়ে আসে। অবশেষে মগজের সিন্দুক চিন্তাশূন্য পড়ে থাকে। আর সেখানে লেপ্টে থাকে নজিরবিহীন রুগণ প্রতিযোগিতা। এমআইটির ইমেরিটাস অধ্যাপক, তাত্ত্বিক, শিক্ষাবিদ ও জনবুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি বলেন, অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে মানুষকে সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
কেউ কেউ বলতে চান, ব্যাংকিং শিক্ষা না দিয়ে সচেতনায়নের শিক্ষা দিলে শিক্ষার্থীরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে বিপ্লবী ও উন্মত্ত হয়ে উঠবে। এ কারণে কিছুটা-বিকাশমান-শিল্প খাত প্রয়োজনীয় শ্রমিক জোগাড় করতে ব্যর্থ হবে। আর সচেতন শিক্ষার্থীরা উৎপাদন ও সেবা খাতে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে আগ্রহী হবে না। এ অপযুক্তির বিপরীতে হাজির করা যায় ব্রাজিলের খ্যাতিমান শিক্ষা দার্শনিক পাওলো ফ্রেরির অভিজ্ঞতা। শিক্ষা নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো এই তাত্ত্বিক ও অ্যাক্টিভিস্ট পেডাগোজি অব দ্য অপ্রেসড গ্রন্থে লিখেছেন, ‘...বাস্তবিক ক্ষেত্রে সচেতনায়নের ফলে উন্মত্ততার জন্ম হয় না। বরং উল্টো, সচেতনায়ন মানুষকে দায়ীত্বশীল সাবজেক্টে পরিণত করে, তাদেরকে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করানোর সুযোগ দেয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত করে উন্মত্ততা পরিহারে সহায়তা করে।’ প্রকৃতপক্ষে সচেতনায়নের শিক্ষার মধ্য দিয়ে চেতনার জাগরণ ঘটে এবং সামাজিক অসন্তোষ দূর হয়।
এই অসন্তোষের সূত্র ধরে বলা যায়, বাংলাদেশের সামাজিক জনপরিসর আজ প্রবলভাবে অসহিষ্ণু। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আক্রান্ত। আধিপত্যবাদ, আভিজাত্য আর দাম্ভিকতা প্রদর্শনে উন্মুখ। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে একটি নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। এদের অধিকাংশের কাছেই সনাতনী মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ও জীবন আকাঙ্ক্ষা (যেমন : ধর্মভীরুতা, জৌলুসহীন জীবনযাপন ও উন্নত চিন্তা চর্চা) মূল্যহীন। এরা ঊর্ধ্বমুখী-উন্নয়ন সংস্কৃতির উচ্ছিষ্টভোগী, বলছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এ মধ্যবিত্ত মনে করেন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গণতন্ত্রহীনতা ও মাস্তানতন্ত্রের চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে তাদের বৈষয়িক অর্জন আরো বাড়বাড়ন্ত হবে। তারা এও বিশ্বাস করেন, যেহেতু জ্ঞান-বিজ্ঞান-অঙ্গীকার-সৃষ্টিশীলতায় তাদের অর্জন নেই, তাই চলমান ব্যবস্থার মধ্যেই তাদের শ্রেণিস্বার্থ সবচেয়ে বেশি সংরক্ষিত থাকবে। আবার, যেহেতু এই শ্রেণির কাছে গভীর চিন্তা ও দর্শনভিত্তিক বিশ্লেষণ গুরুত্বহীন, তাই তারা গণতান্ত্রিক চেতনাবিহীন এবং নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে প্রবলভাবে আগ্রহী। কখনো কখনো মরিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে ‘সড়ক হত্যাকাণ্ডে’ দায়ীদের শাস্তি কমিয়ে আনার জন্য সংঘটিত ধর্মঘট-আন্দোলনের দিকে দৃষ্টি দিলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে কমপক্ষে। এসব কারণেই ‘ইতিবাচক’ মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষরা এখন মূলধারার রাজনীতি ও সামাজিক পরিসরে অনেকটা অবহেলিত, নিপীড়িত, বিপন্ন।
এই বিপন্নতার আগুন উসকে দেওয়া কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গণতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় ও সক্ষম রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অভাব। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। তাই বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা তৈরি হয়নি। যেটুকু ছিল তাও হারিয়েছে অনেকটা। জনগণের মাঝে তৈরি হয়েছে আইন না মানার প্রবল উন্নাসিকতা। আইনকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিলের হীন ইচ্ছা ধারণ করছেন আজকাল অনেকেই। সে কারণেই কেউ কেউ এখন আইনের ব্যাপারে খোঁজখবরও রাখতে খুব একটা আগ্রহী নন। ব্যতিক্রম তো অবশ্যই কিছু আছে। তবে সাতচল্লিশ বছর সময়ের মাপকাঠিতে তা খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়।
জনগণ যে আইনের এবং গণতান্ত্রিক অনুশীলনের ব্যাপারে উদাসীন তার কারণ আলোচনা করতে গিয়ে বলা যায়, সাধারণ মানুষ তাদের নেতৃবৃন্দের মতো হয়ে উঠতে চান। পুরোধা মনোবিশ্লেষক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ‘আইডিয়াল ইগো’র ধারণা নিয়ে এ ব্যাপারটি পরিষ্কার হোক। মানুষ যার মতো হয়ে উঠতে চায় তার আচার-আচরণ ও জীবন পদ্ধতি অণুকরণ করে। এ ব্যাপারটি কি অস্বীকার করা যাবে যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ও রাষ্ট্রীয় আধিকারিকদের অনেকেই তো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদাসীন? একই সঙ্গে তারা আবার অনেকের কাছে অনুসরণীয় বটে! কার্যত দেখা যায়, আইন অমান্য করে যে যত দৃঢ়ভাবে টিকে থাকতে পারে, সে সাধারণ মানুষের কাছে তত উচ্চ স্তরের ‘বীর’। আর ‘বীরের’ উপাসকরা ছোট ছোট পরিসরে ওরকম শৌর্যের প্রমাণ দিতে ঘাটতি রাখবেন, সেটা কী করে হয়!
সাধারণ জনগণের মাঝে অসহিষ্ণুতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার আরো একটি কারণ দেখানো যায়, যার সঙ্গে ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী মানসিকতার এক রকম সন্ধিতা আছে। উপনিবেশের প্রভাবে দখলকৃত অঞ্চলের মানুষেরা যেমন পশ্চিমা আলোকায়নের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করল, আবার শাসন-শোষণ এবং তোষণে তেমনিই অনুসরণ করতে চাইল ঔপনিবেশিক প্রভুদের ফ্যাসিবাদী কায়দা-কানুন। স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরেও এ দেশের শাসনব্যবস্থায় উপনিবেশের স্মৃতিচিহ্ন গভীরভাবে লেগে থাকল। পদের নাম ডেপুটি কমিশনার অথচ এর বাংলা করা হলো ‘জেলা প্রশাসক’। পদের মানুষটি তো শব্দগতভাবেই প্রকৃষ্টরূপে শাসক। প্রশ্ন জাগে, প্রকৃষ্ট রূপটি কে নির্ধারণ করেন? যাই হোক, সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক হলে স্বাধীন দেশে এ পদটির নাম হয়তো হতে পারত ‘জেলা সেবক’। সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বপ্ন নিয়ে জন্ম নেওয়া দেশে শাসক বদলাল। কিন্তু ব্যবস্থা বদলাল না খুব একটা। উপনিবেশিত মানুষের অন্তরে রয়ে গেল সামন্তবাদী ও মাস্তানতান্ত্রিক সংস্কৃতি। সেই পথ ধরে জনগণের মনে আজও হতাশা যেমন আছে, তেমনি আছে নিপীড়নকামী বিকৃত হিংসার বোধ। সচরাচর তারই বেপরোয়া প্রদর্শন চলে সামাজিক পরিসরে। নেতা-নেতৃবৃন্দের এলাকায় আগমন উপলক্ষে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে কর্মী সমর্থকদের যে ‘মোটর-বাইক-শো-ডাউন’ তা প্রায়ই যেন ভুলিয়ে দেয় যে, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে এ দেশে একদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল!
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশ জন্ম নিল সেখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতির মঞ্চে দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে হাজির হলো। মঞ্চে যেমন, তেমনি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের আনাচে-কানাচে। গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার পতনের পর নতুন এক সুযোগ এসেছিল। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির জনকের প্রশ্ন আর জাতীয় সংগীতের ব্যাপারে আমরা পুরো জাতি কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলাম না আজো! এর চেয়ে লজ্জা, অক্ষমতা আর কী হতে পারে! মুক্তিযুদ্ধের ঝাণ্ডাবাহী রাজনৈতিক দলসমূহ কি এ দায় এড়াতে পারে? ভোটের আর জোটের রাজনীতির ফাঁদে পড়ে, ঔপনিবেশিক ধাঁচে শাসন ব্যবস্থা জারি রাখতে গিয়ে, পেশাজীবীদের মাঝে এলিটিজম বহাল রাখার প্রয়াশে, অর্থনীতিতে লুণ্ঠনতন্ত্র কায়েম রাখার কারণে এবং সর্বোপরি জনতোষণবাদ জারি রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মূল সমীকরণ যে আজও মেলানো হলো না। এর দায় কার?
এই দায় নিয়ে যখন কথা বলছি, তখন চারদিকে নির্বাচনের উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা। এই নির্বাচন ময়দানে দাঁড়িয়ে প্রধান দলগুলো শপথ নিক আগামী দিনে যেকোনো কাউকে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেই তা করতে হবে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জনরঞ্জনবাদী বয়ান বন্ধ করে প্রকৃত অর্থে তিন আকাঙ্ক্ষা—সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে উন্নয়ন, রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা চালাতে হবে। উন্নয়ন হতে হবে নদীর মতো প্রবহমান। যা দুকূল ছাপিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শান্তি আর কল্যাণ পৌঁছে দেবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দুয়ারে।
পাহাড়ের মতো খাড়াখাড়ি হলে তাকে উন্নয়ন বলা যাবে না। কারণ সেটি তোলা ওঠানো অর্থনীতির নিয়ামক সেই অনগ্রসর জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হবে। সে কারণেই খাড়াখাড়ি উন্নয়ন-দর্শন মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এজন্য জনগণকে মানবিক, সৃষ্টিশীল ও সচেতনতার শিক্ষা দিতে হবে। আমলাতন্ত্রকে স্বাধীন ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো করে কার্যত জনগণের সেবক হিসেবে হাজির করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা যোগ্যতা আর দৃঢ়তার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলে সুযোগ নেবে নয়া উপনিবেশিক আধিপত্যবাদীরা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাধানের লক্ষ্যে রাজনীতিবিদরা এগিয়ে এলে মুক্তিপাগল সর্বস্তরের জনগণ ভালোবাসা আর অঙ্গীকার নিয়ে নেতৃবৃন্দের পাশে এসে যে দাঁড়াবেন, সে ব্যাপারে আজ কোনো সন্দেহ রাখার আর অবকাশ নেই। একদিন এই স্বপ্নই তো বুনেছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা।
লেখক : শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।